হারমোনিয়ামের ‘হারমোনিতে’ পাকড়াশী এন্ড কোম্পানির শতবর্ষ, সুরেলা সফরে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন!

হারমোনিয়ামের (Harmonium) সুরসৃষ্টির অন্তরাত্মায় লুকিয়ে থাকা শিল্প ভাবনার শতবর্ষ উদযাপন পাকড়াশী এন্ড কোম্পানির ‘Harmonium সুরে সুরে একশো ‘, সাক্ষী হল সল্টলেকের EZCC প্রাঙ্গণের পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহ। শ্যামসুন্দর কোং জুয়েলার্স (Shyam Sundar Co. Jewellers) নিবেদিত ‘পাকড়াশী এন্ড কোম্পানি’র (Pakrashi & Co) শতবর্ষের হারমোনিয়ামের হারমোনি, সঙ্গীত ভুবনকে আরও সুরেলা করে তুলল। “এই আয়োজন কার্যত অসম্ভব ছিল যদি না এগিয়ে আসতো সংবাদ প্রতিদিন(Sangbad Pratidin)।” তাই সংবাদ প্রতিদিনের কর্ণধার সৃঞ্জয় বসুকে (Srinjay Bose) আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান শ্যামসুন্দর কোং জুয়েলার্স- এর কর্ণধার রূপক সাহা (Rupak Saha)। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে অলংকারের অহংকার বহন করে চলেছে যে শ্যামসুন্দর জুয়েলার্স, তারাও সুস্থ সংস্কৃতির সাক্ষী করে রাখতে চান এই সমাজের আগামী প্রজন্মকে। সেই বার্তাই মিলল অনুষ্ঠানের প্রাথমিক পর্বে।

১০০ বছর ধরে কোনও একটি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে একাধিক প্রতিকূল আর অনুকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ‘পাকড়াশী এন্ড কোম্পানি’র (Pakrashi & Co) ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে হারমোনিয়াম যন্ত্রকে সংগীত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করার কাজটা সহজ ছিল না। সুরসৃষ্টিতে হারমোনিয়ামের (Harmonium) হারমোনি নিয়ে তর্ক শুরু বিংশ শতাব্দী থেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকেই হারমোনিয়ামের আবির্ভাবের এক পরিসর তৈরি হতে থাকে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগিনীর সূক্ষ্ম কাজ নাকি হারমোনিয়ামে ধরা পড়ে না। তাই সঙ্গীতের অনুষঙ্গ হিসেবে এ যন্ত্র কে ঠিক মানায় না, এই কথাই প্রাথমিকভাবে মনে করা হতো। কিন্তু হারমোনিয়ামের ম্যাজিক মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকেও। পরাধীন ভারতেই হারমোনিয়াম নিয়ে ১৯২২ সালে সুধীরচন্দ্র পাকড়াশীর হাত ধরে যাত্রা শুরু পাকড়াশী এন্ড কোম্পানির । প্রায় পঞ্চাশ বছর পর দায়িত্ব নেন সুফল পাকড়াশী। সংস্কৃতি মনস্ক এই মানুষটি বিশিষ্ট হারমোনিয়াম বাদকও বটে। তিনি হারমোনিয়ামকে শুধুমাত্র দেশের মধ্যে আটকে রাখতে চাননি। তাই কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর শিল্প ভাবনার পরিচয় পেল বিশ্ব । ২০০০ সাল নাগাদ বাবার হাত ধরলেন শুভজিৎ পাকড়াশী, যিনি আবার সেতারের অনুরাগী এবং সেতার বাদক। এরপরই পাকড়াশী এন্ড কোম্পানির হারমোনিয়ামের বিদেশ যাত্রা শুরু ২০০৫ সালে। সেই ধারাবাহিকতার সাক্ষী বিশ্বের বারোটি দেশ। সিডনি থেকে অকল্যান্ড, টরেন্টো হোক কিংবা আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। স্বর্ণালী সন্ধ্যায় সেই নস্টালজিয়ায় ফিরলেন সুফল পাকড়াশী (Suphal Pakrashi)। তাঁর স্মৃতির ফ্রেম থেকে সুরবিস্তার করা হারমোনিয়াম কিংবদন্তিদের ছবি সজীব হয়ে উঠল অচিরেই। হেমচন্দ্র, সুধীর, সুফল পাকড়াশীরা নিজেদের ভালবাসা আর সৃষ্টিশীল ভাবনা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম উজ্জ্বল করেছেন ।এখন সেই গুরুদায়িত্ব যথাযথ ভাবে সামলাচ্ছেন এই প্রজন্মের শুভজিৎ পাকড়াশী।

দেখতে দেখতে কেটে গেল ১০০ বছর। ভাবতেও অবাক লাগে আকাশবাণীতে হারমোনিয়াম ব্রাত্য ছিল দীর্ঘ কাল, বিশ্বভারতীও এই যন্ত্রকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে নি সেভাবে। অথচ মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ প্রবাদপ্রতিম হয়েছেন সেই হারমোনিয়াম বাজিয়েই। শুক্রের সন্ধ্যায় প্রেক্ষাগৃহে তখন সোহানলাল শর্মার হারমোনিয়ামের সুর উদ্বেল করেছে উপস্থিত দর্শক – শ্রোতাদের মন। বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস জানালেন এই কোম্পানির হারমোনিয়ামের কথা জানেন না এমন শিল্পী বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পদ্মশ্রী ঊষা উত্থুপ অনুষ্ঠান মঞ্চে উঠতে না উঠতেই একরা হাততালিতে ফেটে পড়ল প্রেক্ষাগৃহ। এরপর সরোদে সেতারে শুরু অনুষ্ঠান। রাগ মধুবন্তিতে সান্ধ্য লগ্নের সূচনা হল। মঞ্চের ব্যাকড্রপে তখন ভেসে উঠছে ভারতীয় শাস্ত্রীয়সঙ্গীত ঘরানার লেজেন্ডদের দৃশ্যপট। পণ্ডিত রবিশঙ্কর থেকে শুরু করে জগজিৎ সিং, জাকির হোসেন থেকে আমজাদ আলি খান, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শ্রাবণী সেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিংবা লতা মঙ্গেশকর থেকে শুরু করে নির্মলা মিশ্র- প্রত্যেকেই পাকড়াশী এন্ড পাকড়াশী এন্ড কোম্পানির হারমোনিয়ামে ঝঙ্কারে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, সহযোগী হয়েছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। আজ ৭ এপ্রিল রবিশংকরের জন্মদিনে তাই প্রারম্ভে উঠে এল তাঁর কথা। এরপরই মঞ্চ মাতালেন শোভন সুন্দর বসু, যিনি প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা কবিতার জগতে আলোড়ন তৈরি করে সৃষ্টি করেছেন বাংলার প্রথম আবৃত্তির ব্র্যান্ড ‘বৃষ্টি’। কথায় আর কবিতায় সুরের মূর্ছনা যখন দর্শকরা অবগাহন করছেন তখন মঞ্চে ভেসে উঠল আরও তিন গুণী শিল্পীর নাম। ইন্দ্রাণী সেন- শ্রাবণী সেনের যুগলবন্দির পরেই এলেন শ্রীকান্ত আচার্য্য। প্রয়াত সুমিত্রা সেনের কণ্ঠে ধ্বনিত হওয়া দুটি গান পরিবেশন করেন ইন্দ্রাণী – শ্রাবণী।হারমোনিয়ামের ‘পাকড়াশী এন্ড কোম্পানি’র রিড যেন আনন্দে তখন মাতোয়ারা। প্রাণ ভরে দর্শক শুনলেন তাঁর কণ্ঠ। একটা সময় ছিল যখন বঙ্গ গৃহকোণে হারমোনিয়ামের অবধারিত উপস্থিতি কারোর নজর এড়াতে পারতো না। শাস্ত্রীয় হোক উপশাস্ত্রীয় বা ধরুন লঘু গানের নানা উপচারের মধ্যে ধ্রুবক— সতত সুরে বেজে চলা পাকড়াশী এন্ড কোম্পানির হারমোনিয়াম। বিজ্ঞাপনের জাঁকজমক এড়িয়ে বেশ খানিকটা প্রচারের অগোচরেই শতবর্ষ পূর্ণ করেছে রাসবিহারী মোড়ে অবস্থিতএই সুরযন্ত্র প্রতিষ্ঠান, যার প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে আছে নস্টালজিয়া। এ যেন এক সর্বাঙ্গ সুন্দর অনুষ্ঠান! একরাশ ভাল লাগা অনুভূতি জমা হল আদি আর নব্য প্রজন্মের মনের খাতায়। সংকটময়তা আর সংকীর্ণতার এই যুগে , চৈত্রের শেষ বেলায় ‘সুরে সুরে একশো’ যেন জীবনী শক্তির রসদকে আরও একটু উজ্জীবিত করে গেল পাকড়াশী এন্ড কোম্পানির দ্বিশতবর্ষ উদযাপনের অপেক্ষায়।

আরও পড়ুন- কো. ভিড মোকাবিলায় তৎপর রাজ্য ! ফের মকড্রিলের ঘোষণা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

Previous articleগাজায় হা.মলা ইজরায়েল সেনার! ক্ষতিগ্রস্ত বহু বাড়ি
Next articleমুখ্যমন্ত্রী নির্দেশের পরেই বর্ধিত পার্কিং ফি প্রত্যাহার করল KMC