‘এন্টার দ্য ড্রাগন’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

রাস্তায় বখাটে ছেলেদের হাতে প্রায়ই মার খেতো ছেলেটি । বেদম মার । প্রত্যাঘাত দূরের কথা , প্রতিরোধ পর্যন্ত করতে পারতো না শান্ত নিরীহ সেই ছেলে । মূলত আত্মরক্ষার তাগিদে সে ঝুঁকে পড়ে মার্শাল আর্টে । পরবর্তীতে এই ছেলেটির হাত ধরেই চলচ্চিত্রে পা রাখে মার্শাল আর্ট । তারপর তো ইতিহাস । দুনিয়া কাঁপিয়ে কোটি কোটি মানুষের মন জয় করে মাত্র ৩২ বছর বয়সে তাঁর অকাল মৃত্যু আজও রহস্যের চাদরে ঢাকা। এই মানুষটি নব মার্শাল আর্টের জনক ব্রুস লি । যাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু নিয়ে নানা সন্দেহ ও বিতর্ক আজও বহমান ।

একের পর এক সুপারহিট ছবি , রহস্য , রোমাঞ্চ আর অভিনবত্বে ভরপুর । তাঁর সমকালে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই অভিনেতার হঠাৎ মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারে নি । ১৯৭৩ সালে একটি সিনেমার শুটিং চলাকালীন ব্রুস লি হঠাৎ করেই ভীষণ অসুস্থ বোধ করেন , তাঁর মস্তিষ্কে প্রদাহ শুরু হয় এবং মাথা ফুলে উঠতে থাকে । অসহ্য , ভয়াবহ যন্ত্রণা হতে থাকে ।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগের নাম সেরিব্রাল এডেমা । ডাক্তারদের সার্বিক চেষ্টায় সেই যাত্রায় কোনোভাবে রেহাই পেলেও তাঁর সেই মুক্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় নি । কয়েক সপ্তাহ পর থেকে আবার মাথা ফুলতে থাকে । ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই তাঁর এক সহ-অভিনেত্রী বেটি টিং পেইর কাউলুনের বাড়িতে সিনেমার শুটিং সংক্রান্ত একটি প্রয়োজনে যান ব্রুস লি । সেখানে আবার মাথাব্যথা শুরু হওয়ায় তাঁকে ইকুয়াজেসিক নামে একটি পেইনকিলার খেতে দেওয়া হয় । সেটা খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েন তিনি । কিন্তু তারপর আর কিছুতেই ঘুম থেকে ওঠানো যাচ্ছিল না তাঁকে । এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে । ডাক্তাররা বারবার তাঁর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন । তার কয়েক ঘণ্টা পরেই ঘোষণা করা হয় ব্রুস লি মৃত ।

বিতর্কিত মৃত্যু । অস্বাভাবিক মৃত্যু । ব্রুস লি কেন মারা গেলেন অকালে ? অতিরিক্ত ড্রাগ নেওয়ার ফল ? তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ কি তাঁর অস্বাভাবিক ডায়েট ? কাঁচা ডিম ও কাঁচা মাংস খেতেন তিনি । পান করতেন কাঁচা দুধ। নিজেকে ফিট ও তাজা রাখতে উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার খেতেন তিনি । তাঁর মৃত্যুর প্রাথমিক ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট অ্যালার্জির কারণে তিনি মারা গেছেন । মাথা ব্যথা থেকে রেহাই পেতে তিনি নিয়মিত ব্যথা নিরোধক ওষুধ খেতেন । তাই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক । আবার তাঁর মৃত্যু নিয়ে এমন কথাও শোনা যায় যে , এক শ্রেণীর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও মাফিয়াদের চক্রান্তের শিকার হন তিনি । তাঁর অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা ও বক্স অফিসের বিপুল চাহিদা দেখে কিছু পরিচালক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠেন । ব্রুসের ছবির সঙ্গে তখন অন্য ধারার ছবিগুলো কিছুতেই পাল্লা দিতে পারছিলো না । তাই ব্রুস লি-কে সুকৌশলে হত্যা করা হয় , এমন ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না ।

হংকংয়ের কিছু মাফিয়া ব্রুসের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল । এমনকি এমনও শোনা যায় যে তাঁকে খুন করার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করা হয়েছিল । অসুস্থ অবস্থায় যে অভিনেত্রীর বাড়িতে পেইনকিলার খেয়েছিলেন ব্রুস , তাঁকেও অনেকেই দায়ী করেন ব্রুসের মৃত্যুর জন্য । ডাক্তারদের একাংশ মনে করেন অতিরিক্ত ক্যানাবিস সেবন কিংবদন্তি অভিনেতার মৃত্যুর কারণ হতে পারে । তাঁরা এও দাবি করেন যে , হাসিস ও মারিজুয়ানার মতো ড্রাগের কারণে তাঁর মস্তিষ্ক ফুলে উঠেছিল । একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলেন যে , অতিরিক্ত ডোজের ক্যানাবিসে বিষাক্ত কিছু থাকতে পারে । আবার অনেক মনে করেন তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ তাঁদের পারিবারিক অভিশাপ । তাঁদের পরিবার নাকি অভিশপ্ত । ব্রুস লি-র বড়ো ভাইয়ের অকাল মৃত্যু এই সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে ।

” Knowing is not enough , we must apply ” , বলে গেছেন ব্রুস লি । ব্রুস ইউন ফান লি ( নভেম্বর ২৭ , ১৯৪০ — জুলাই ২০ , ১৯৭৩ ) একজন চীনা মার্শাল আর্ট শিল্পী , শিক্ষক , অভিনেতা এবং ‘ জিৎ কুন
দো ‘ নামক নতুন ধরনের মার্শাল আর্টের স্রষ্টা । তাঁর জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে । তাঁর মৃত্যু হয় হংকং- এ । সিনেমায় শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় তাঁর পায়ের কাজ ও শরীরের ভারসাম্য রক্ষার অসামান্য কৌশল সারা বিশ্বকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছে বারবার । মার্শাল আর্টের মাধ্যমে শত্রু দমনের সময় বারবার মনে হয় যেন নৃত্যরত ব্রুস লি । ছোটবেলায় কুংফু শিখেছেন তিনি , সঙ্গে নাচ ও অভিনয় । সিয়াটলে থাকার সময় তিনি তিনি তাঁর প্রথম মার্শাল আর্ট স্কুল খোলেন । সেই সময়েই তিনি তাঁর নিজস্ব কৌশলে তৈরি করেন অভিনব এক ঘরানা ।

জিৎ কুন ডো , প্রাচীন কুংফু , বেড়া , বক্সিং ও দর্শনের যথাযথ সংমিশ্রণে তৈরি নতুন এক শৈলী , স্বাতন্ত্রে ও গতিময়তায় যা আজও অনন্য , যা আজ বিরল এক শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে । আজও ‘ এন্টার দ্য ড্রাগন ‘ (১৯৭৩ ) চলচ্চিত্রটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় ও সুপারহিট ছবি হিসেবে বিশ্ববন্দিত । এই ছবি ব্রুসকে আন্তর্জাতিক মুভি স্টারডমে পরিণত করে । কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে , এই ছবিটি হংকং-এ মুক্তির ছ ‘ দিন আগে ব্রুস লি মারা যান।

এমন বর্ণময় প্রতিভা সচরাচর বিরল । একেবারে একার চেষ্টায় পশ্চিম বিশ্বে চীনা সংস্কৃতির ধারণা বদলে দিয়েছিলেন ব্রুস লি । অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্র গতিতে তিনি যেভাবে তাঁর হাত ও পা ব্যবহার করতেন তা দেখে সারা বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম বিমোহিত হতেন ।‌ তাঁর অনন্য স্টাইল আজও অননুকরণীয়।

আরও পড়ুন- কাঁথিতে প্রার্থী দিল কংগ্রেস, ঝুলে রইল জয়নগর

 

Previous articleকাঁথিতে প্রার্থী দিল কংগ্রেস, ঝুলে রইল জয়নগর
Next article‘শাহজাদা’ হারবেন ওয়েনাড়ে, রাহুলকে কটাক্ষ মোদির