পুজোর সাহিত্যের সেকাল একাল

কলেজ থেকে ছুটির পর ফেরার পথে স্টেশনে ট্রেন থামলে সামনে তাকিয়ে দেখি অনেকটা দূরে পেঁজা তুলোর মত সাদা সাদা মেঘ যেন মাটিতে নেমে এসেছে! যেন এই লাল রাস্তা ধরে সোজা এগোলেই পৌঁছে যাব মেঘের বাড়ি! আকাশটা ঝকঝকে নীল। মায়াবি উজ্জ্বল রোদ। বুঝলাম শরৎ এসেছে। শরতের একটা নিজস্ব রঙ আছে। রঙটা ঝলমলে সোনালি। এ রঙ আলোর রঙ, রোদ্দুরের রঙ, উচ্ছ্বলতার রঙ। দুগ্গা ঠাকুরের পরনের সাজ আর মাথার মুকুটেও আছে এই রঙ। শরতের এই রঙ অনাবিল আনন্দের।

শরৎ মানেই শিউলির গন্ধ মাখা শিশিরভেজা ভোর, ঢাকের বাদ্যি, ধূপ, ধুনো আর কর্পূরের গন্ধ, অঞ্জলি, সন্ধিপুজো, একশো-আট গোলাপি পদ্ম কি ঝলমলিয়ে ওঠা একশো আট প্রদীপের আলোর এক ম্যাজিক রিয়্যালিজম। শরৎ মানেই উৎসব, আর উৎসব মানেই পুজো। প্রতিবছরই পুজো আসে। কিন্তু প্রতিবছরই যেন নতুন করে আসা। তাই পুজো এলেই মনের ভেতরটা হৈহৈ করে ওঠে। প্রতিদিনের যাপন থেকে কোথাও যেন একটা মুক্তির স্বাদ! সেই মুক্তির আর একটা স্বাদ হলো পুজো সাহিত্য ।

সাহিত্যপাঠের অনাবিল আনন্দের খোঁজ করতে গিয়ে দেখি সেখানেও উজ্জ্বল অবদান রবীন্দ্রনাথের। বাঙালির হৃদয়ের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা মাখা শারদোৎসব দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম ভেবেছিলেন পুজোর ছুটির অবকাশে বাঙালি পাঠকের হাতে একখানি মোটাসোটা পত্রিকা তুলে দেবার কথা। ১২৯৮ সালের অগ্রহায়ণ মাসে তাঁর নির্দেশনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রিকার প্রথম সংস্করণ। এই কাগজেরই ১২৯৯ সালে ভাদ্র-আশ্বিন যুগ্মসংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল পুজোসংখ্যা হিসেবে। কলকাতায় এই পত্রিকার সম্পাদনার সহায়ক ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই সংখ্যায় কবির ‘স্বর্ণমৃগ’ নামে একটি দীর্ঘ গল্প ছিল। সেও শরতের গল্প———-
“আশ্বিনমাসে দুর্গোৎসব নিকটবর্তী হইল। চতুর্থীর দিন হইতে ঘাটে নৌকা আসিয়া লাগিতে লাগিল। প্রবাসীরা দেশে ফিরিয়া আসিতেছে……মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্যকিরণ উৎবের হাস্যের মত ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, পক্কপ্রায় ধান্যক্ষেত্র থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, বর্ষাধৌত সতেজ তরুপল্লব নব শীতবায়ুতে শির শির করিয়া উঠিতেছে।”

আজও বাংলা সাহিত্য প্রকাশনার অন্যতম বড় পর্ব শারদোৎসবকে ঘিরে। ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি জুড়ে আছে পুজোর বই- জামা – আড্ডা খাওয়া দাওয়া , পুজোর নতুন জামা-জুতোর মতই পুজোর বাজারের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল শারদীয়া পত্রিকা। ঢাকে কাঠি পড়ার আগেই হৈহৈ করে হাজির রঙবেরঙের শারদীয়া পুজোসংখ্যা।

আমাদের ছোটবেলায় এতো টিভি চ্যানেল ছিল না, ইন্টারনেট আর সেলফোনও তখন বিরল। কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বড়োদের ছুটির বিনোদন বলতে ছিল কয়েকটি পুজোসংখ্যা আর সাথে কোথাউ বেড়াতে যাওয়া । আনন্দমেলা সারাবছরই আসত কিন্তু সেইভাবে পড়া হয়ে ওঠেনি । সেখানে দেখা দিত ফেলুদা, কাকাবাবু-সন্তু, প্রোফেসর শঙ্কু, কিকিরা, গোগোল, অর্জুন- সব্বার সঙ্গে! থাকবে টিনটিন আর কুট্টুসও! আর সেইসঙ্গে সেইসব ঝকঝকে রঙিন কিংবা সাদাকালো ছবি। কোন গল্পে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, কোনটায় বা সুধীর মৈত্র, আবার কোনটায় সমীর সরকার কি অনুপ রায়ের দুর্দান্ত সব ছবি। এইসব ছবির হাত ধরে, গল্পের সঙ্গে সঙ্গে চলত কল্পনার জাল বোনা! অসামান্য কার্টুনের সম্ভার নিয়ে থাকতেন রেবতীভূষণ, দেবাশিস দেব। ‘

ছোট বয়সে শারদীয়া ধরা দিত অন্যভাবে ঠাকুমা স্নান সেরে জানলার ধারে নতুন বই নিয়ে বসতেন আর পাশ থেকে হাল্কা হাল্কা পেতাম নতুন বই এর গন্ধ । সেখান থেকেই আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলাম সাহিত্য কী এবং এর প্রতি আকর্ষণটা কতটা হতে পারে । সেই ভাবেই একটু একটু করে সাহিত্য জগতের বিভিন্ন লেখকদের লেখার ধরনের সাথে পরিচয় । সারাবছর চলতো ঠাকুমার আলমারি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন বই পড়া। তারপর মহালয়ার কিছুদিন আগেই যখন একটার পর একটা বই আসতো বাড়িতে সেগুলো হাতে পেয়েই সবার আগে চোখ যেত সূচীপত্র । নবকল্লোলে পছন্দের লেখকের তালিকায় থাকতেন মহাশ্বেতা দেবী , প্রফুল্ল রায় , আশাপূর্ণা দেবী , শক্তিপদ রাজগুরু , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , শান্তিপ্রিয় বন্দোপাধ্যায় , সৈয়দ মুজতবা সিরাজ উপন্যাস । ভ্রমণে কলম ধরতেন চিত্রা দেব, শান্তিপ্রিয় বন্দোপাধ্যায় এনাদের লেখা গুলোই ভেসে উঠতো । সেখানেই পড়া প্রফুল্ল রায়ের একটা দারুণ উপন্যাস ‘কেয়া পাতার নৌকা’ । শেষ লাইনটা পড়লেই মন খারাপ হয়ে যেত একটাই কারণে তা হলো আবার পরের অংশটুকু র জন্য এক বছরের অপেক্ষা । মন ভারি হওয়ার থেকেও বেশি সমস্যা হত পরেরবছর আগের অংশটা মনেই থাকতো না ; তবুও পড়েছি এই মনোভাব নিয়েই অপেক্ষা । পুরাণে কম বেশি সমস্ত পত্রিকাতেই নজর কাড়েন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরি । তারপর আরো কিছুদিন পরে হাতে আসে ‘শারদীয়া বর্তমান’ । সেখানেও মোটামুটি চেনা মুখেরই ভিড় । —– ভ্রমণে শিবশঙ্কর ভারতী ; উপন্যাসে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মহাশ্বেতা দেবী , প্রফুল্ল রায় , তপন বন্দোপাধ্যায় আরো পরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বাণী বসু, বিনতা রায়চৌধুরী প্রমুখ । এছাড়াও থাকত গল্প, ছড়া, ফিচার, গদ্য আর সব থেকে আকর্ষণীয় সেলবদের পুজোর ঘর। তারপর একে একে হাতে পৌঁছাত দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা সব কিছুই । পড়ার ফাঁকেই চলত সারা বছরের রসদ সঞ্চয়। নবকল্লোল’ , ‘দেশ’ প্রভৃতি বইগুলো পুজোর ক’দিন আগেই উপহার পেতাম । পড়ার বইগুলো শিকেয় তোলা থাকতো সব পুজোবার্ষিকী পড়ে ফেলতে হবে না হলে নাকি দুগ্গা মা পাপ দিতেন !!!

এখনকার শারদীয়া ভরে ওঠে প্রচেত গুপ্ত, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, হর্ষ দত্ত, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী , সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, তিলোত্তমা মজুমদার, সৌরভ মুখোপাধ্যায়, হিমাদ্রি কিশোর দাশগুপ্ত, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী র কলমে। আগের লেখকদের জৌলুস হয়তো অনেকটা কমে গেছে তবুও বর্তমান প্রজন্ম সাহিত্যে অসাধারণ কৃতিত্ব সৃষ্টি করছে । আশা করা যেতে পারে এই প্রজন্ম আবার সাহিত্যে পুরানো মাহাত্ব ফিরিয়ে আনবে।

একবার পুজো সংখ্যায় পড়লাম বানী বসুর ‘জেগে ওঠো।’ এক আশ্চর্য গল্প। সেই গল্পে পৃথিবীর নানা প্রান্তের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কোন দুঃখের বা হিংসার ঘটনা দেখলেই ঘুমিয়ে পড়ছিল চিরকালের জন্য। গল্পের শেষে ছিল বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রনেতাদের প্রতিশ্রুতি।

আমাদের এই দুর্গা পুজো কী পুরনো হবে কোনও দিন? যতই সোশ্যাল মিডিয়া, আইফোন, ট্যাব, টিভির পর্দার ঝাঁ চকচকে রিয়্যালিটি শো-নিত্যনতুন রূপে হাজির হোক, এখনও শরৎ-আকাশের সাদা মেঘ আর কাশফুলে দোলা দিয়ে মা আসেন স্বমহিমায়। এখনও সিলেবাসের বাইরে খানিক অবকাশে ছোটরা যাতে আনন্দ পায়, সেই আশায় ভারি যত্ন নিয়ে প্রকাশিত হয়ে চলেছে শারদসাহিত্য। এই তথ্যপ্রযুক্তির রমরমাতেও ছাপা পত্রিকার চাহিদা একটুও কমেনি। পাঠক আগের মতোই প্রতিবছর অপেক্ষা করে থাকেন শারদ সংখ্যাগুলি প্রকাশের জন্য। আর প্রকাশিত হলেই তাঁরা সাগ্রহে সংগ্রহ করেন।

শরতের সোনা-রঙা রোদ আর উপচে পড়া খুশি নিয়ে আমার যে ছোটবেলার শরৎ ছিল, আজ নেই। এখন আর শিউলি ফুলের মায়াবি গন্ধ নেই । কাশের বনে লুকোচুরি খেলা নেই । আরো পরে হয়তো এইসব কিছুই থাকবে না ফাইভ জি র জৌলুস হয়তো পুজোর চারটে দিনকেও ম্লান করে দেবে । আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নতুন জামার আনন্দ টা ই বড়ো মলিন কষ্ট হয় সেই সমস্ত ছেলেবেলা দেখে । তারাও হয়তো কোনোদিন বলে বসবে “বাংলা টা ঠিক আসেনা” সাহিত্য অনেক দূর ।

আরও পড়ুন-এবার পুজোয় খোলা থাকছে তন্তুজের শোরুম

 

Previous articleগঙ্গার ঘাটে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তর্পণ সারলেন লকেট
Next articleশনিবার বৈঠকের পরই চূড়ান্ত হবে টালা ব্রিজের বিকল্প রুট