আমার বাবা অনিল বিশ্বাস

(প্রয়াত সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর একমাত্র মেয়ের লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছচ্ছে। আমরা অনেকের সঙ্গে শুধু সেই দায়িত্বটুকু পালন করলাম।)

আমার বাবা খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। অর্থকষ্ট এবং চরম দারিদ্রের জন্য কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন বহুদিন না খেয়ে বা আধপেটা খেয়ে থেকেছেন। এরফলেই বাবার যক্ষা হয়ে গিয়েছিল। বাবার শরীর বরাবর দুর্বল ছিল। এই যে এত কম বয়সে (৬২ বছর) চলে গেলেন, সেটাও ওই কারণেই। আমি প্রায় ছোট বেলা থেকেই জানি, বাবার কিডনির সমস্যা।

আমাদের পরিবার কংগ্রেসি ঘরানার ছিল। তিন ভাই এবং এক বোনের মধ্যে আমার বাবাই ছিলেন কনিষ্ঠ। আমার জ্যেঠুরা রীতিমতো কংগ্রেসি আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু মাঠে ময়দানে রাজনীতি করতেন না। আমাদের পারিবারিক ব্যবসাও ছিল। তবে দারিদ্র্যও ছিল চরম। আমার ঠাকুরদা তখন নেই, জ্যেঠুরাও চাননি যে তাঁদের ছোট ভাই রাজনীতি করুক। তাঁরা চাইতেন, ভাইও ব্যবসাটাই দেখুক। কিন্তু, বাবার বরাবরের ঝোঁক বাম রাজনীতির প্রতি। বাবা কিছুতেই ব্যবসা করতে চাননি। সে সময় আমার বাবাকে আগলে রেখেছিলেন আমার মেজ জ্যেঠিমা। তিনি আমার বাবার থেকে বছর তিনেকের বড় ছিলেন। ফলে সম্পর্কটা একেবারেই বন্ধুর মতো ছিল। এবার বাবা তো কিছুতেই ব্যবসা করবেন না। তিনি বরং নদীয়ার করিমপুর ছেড়ে কৃষ্ণনগরে এসে কলেজে পড়তে চান। সে সময় আমার মেজ জ্যেঠিমাই তাঁর গয়না বিক্রি করে বাবাকে কৃষ্ণনগরে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তখন থেকেই বাবা সরাসরি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বাবা কৃষ্ণনগরে কলেজে পড়ার সময় থেকেই সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। আর এই গোটাটাই কিন্তু, আদর্শবোধ এবং পার্টির প্রতি গভীর ভালবাসা থেকে। সেখানে ‘কেরিয়ার’ গড়ার বা ‘পেশাদার’ হওয়ার ঠিক কোনও ব্যাপার ছিল না।

আরও পড়ুন – নারদ তদন্তে মুকুল-মির্জাকে মুখোমুখি বসিয়ে তদন্ত সিবিআইয়ের

কৃষ্ণনগর থেকে বাবা এরপর কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাশ করেন। রাজ্যে তখন কংগ্রেসি শাসন। বাবা সম্ভবত জেল থেকে এম.এ পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং রীতিমতো ভাল নম্বরও পেয়েছিলেন। কলকাতায় আসার পর থেকেই দীনেশ মজুমদার-সহ আরও বেশ কয়েক জন সিনিয়রের নেতৃত্বে কাজ শুরু করে দেন। প্রথম থেকেই বাবা গণশক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর গণশক্তির সঙ্গেই দীর্ঘ যাত্রা। পরে পার্টির রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব…। আসলে বাবা পার্টিকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলেন। সেই ভালবাসা এতটাই ছিল যে মৃত্যুর আগে শেষ কথাটাও বাবা প্রকাশ আঙ্কেলের (প্রকাশ কারাট) সঙ্গেই বলেছিলেন। আসলে বাবার থেকে অনেক কিছু শেখার ছিল। এইসব শিক্ষাগুলি নিয়েই আমি বেঁচে আছি। যেমন একটা উদাহরণ দিই, আমার যে বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল এবং আজও আছে, সে যখন ক্লাস নাইনে পড়ে, তখন তার মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর থেকেই আমার বন্ধুটি অধিকাংশ সময় আমাদের বাড়িতেই থাকত। একদিন স্কুল ছুটির পর বাড়িতে এসে ওর সামনেই আমি আমার মা-কে খুব আদর করছিলাম। বাবা সে সময় সামনেই ছিলেন। পরে রাতে আমাকে বলেছিলেন, যার যেটা নেই, তার সামনে সেই বিষয়টাকে নিয়ে বিশেষ আনন্দ-উপভোগ করতে নেই। বাবা মানুষটা ভীষণ সংবেদনশীল ছিলেন। বাবা সব সময় বলতেন, মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলো না, এটা অন্যায়। আবার কখনও যদি রেগে গিয়ে কারও সমালোচনা করতাম, তখন বাবা রেগে যেতেন। বলতেন, মানুষের ভাল দিকগুলি নিয়ে আলোচনা কর, নেতিবাচক দিক নিয়ে চর্চা করে কখনও লাভ হয় না। বাবার এই শিক্ষাগুলি আমার মধ্যে গেঁথে গিয়েছে। সকলের সঙ্গেই বাবার বন্ধুত্ব ছিল। তবে বুদ্ধকাকু আর বাবা ছিলেন একেবারে সমবয়সী। ওঁদের একই দিনে জন্ম। এছাড়া, সুভাষকাকু, বিমান জ্যেঠু, শ্যামল জ্যেঠু সকলের সঙ্গেই খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। জ্যোতি বসুও বাবাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার মনে পড়ে, আমাদের সেই ভাড়া বাড়িতে একবার জ্যোতি বসু এসেছিলেন। কলকাতায় চলে আসার পর থেকে বাবার সারাটা জীবনই আসলে গণশক্তির সঙ্গেই কেটেছে।

বাবা যে কোনও বস্তুবাদী দৃষ্টিতে দেখতেন। বাবার সব থেকে বড় অবদান বলতে আমি মনে করি, নতুন সাংবাদিকদের তুলে নিয়ে আসা। বাবা পার্টির ছাত্র সংগঠন থেকে যোগ্য এবং প্রতিভাবানদের খুঁজে এনে গণশক্তির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এরপর বাবার অভিভাবকত্বে তাঁরা সাংবাদিক হয়ে উঠেছেন। আমার ছোটবেলায় দেখেছি, সম্পাদকের যাবতীয় দায়িত্ব সামলেও রাত অবধি জেগে থেকে বাবা গণশক্তি ছাপার গোটা প্রক্তিয়াটা দেখভাল করতেন। সত্যিই তাই।

আরও পড়ুন – মেয়ের রং কালো, শিশুকন্যার প্রতি নৃশংস বাবা!

বাবা কখনও পার্টির পদকে গুরুত্ব দেননি। ওনার কাছে সবই ছিল পার্টির কাজ। সেই কাজটা কখনও গণশক্তির সম্পাদনা, আবার কখনও পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব। এগুলো সব একেকটা ভূমিকা। তাই বাবা যেদিন রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হলেন সেদিনও বাবার মুখ দেখে ঘুণাক্ষরেও কিছু বুঝতে পারিনি। এমনকি আমাদের বলেন নি কিছু। অন্যান্য দিনের মতোই বাবা রাতে বাড়ি ফিরে গল্পগুজব করে খেয়েছেন এক সঙ্গে। শুধু অনেক টেলিফোন এসেছিল সেদিন। তাও তেমন বুঝিনি যে পার্টির রাজ্য সম্পাদক হয়েছেন। পরদিন সংবাদপত্র দেখে আমরা জানতে পারি। বাবা-মা ছোট থেকেই খুব সাধারণভাবে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। আমার মা বাসে চড়ে অফিস যেতেন।

আমি মনে করি, কমিউনিস্ট পার্টি কোনও একজনকে নিয়ে চলে না। এখনও অনেকে আছেন, যাঁরা লড়াই করছেন। বাবা যদি বেঁচে থাকতেন দমে না গিয়ে আরও বেশি লড়াই করতেন। কমিউনিস্টদের কাছে ক্ষমতায় থাকা বা না থাকাটা লড়াইয়ের ক্ষেত্রে খুব ফারাক করে দেয় না। বাবা তাঁর কমরেডদের নিয়ে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে লড়তেন বলেই আমার বিশ্বাস।

✍ অজন্তা বিশ্বাস

আরও পড়ুন – মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত্যুবার্ষিকীতে ট্যুইট করে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন মুখ্যমন্ত্রীর

 

Previous articleরোহিত ভেমুলার বিশ্ববিদ্যালয়ে ধরাশায়ী গেরুয়া
Next articleডবল সিলিন্ডার? সাবধান হোন