ঠিক কী চাইছেন তিনি ? কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

ঠিক কী চাইছেন তিনি ? কেন ক্রমাগত এমন অস্বাভাবিক আচরণ করেই চলেছেন? কোনও স্তরের ‘গুডবুকে’ ঢুকতেই কি এহেন কার্যকলাপ?

কোনও সাংবিধানিক পদাধিকারীর বিরুদ্ধে সাধারনত বিরূপ মন্তব্য করা হয় না৷ মন্তব্য করার রেওয়াজ থাকলে অবশ্যই বলা যেতো, কোনও রাজনৈতিক দলের তৃতীয় শ্রেনির নেতার মতোই ‘সক্রিয়’ তিনি৷ কিন্তু এসব তো আবার বলা যাবে না৷ কিন্তু তথাকথিত এই ‘সুরক্ষা-কবচ’-এর সুযোগ কতদিন নেবেন তিনি? তিনি কী বুঝতে পারছেন না, তাঁর এ ধরনের আচরণে এ রাজ্যের সর্বস্তরের ও সর্বমতের শিক্ষিত সমাজের মনে তাঁর সম্পর্কে যে ধারনা তৈরি হচ্ছে, সেটা সুখকর নয়৷

জানা নেই, তাই বলা উচিত হবেনা, বিশেষ কোনও প্রোগ্রামিং করে দিল্লি থেকে কাউকে কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল করে পাঠানো হয় কি’না ! সব জেনে নিয়েই এসব বলা উচিত৷ ধরে নিই, যদি তেমনও হয়, তাহলেও বলতে হয়, এতে কার বা কোন দলের সুবিধা হচ্ছে ? গণতান্ত্রিকভাবে, প্রশ্নাতীত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শাসনক্ষমতায় থাকা কোনও সরকারকে এই পথে ‘ডি-স্টেবিলাইজড’ করা যায় না’কি ? বরং ঠাণ্ডামাথায় বার বার বিতর্ক তৈরি করে সাংবিধানিক একটি পদের অবমাননা ও সম্মানহানিই ঘটানো হচ্ছে৷ এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে দেশজুড়ে একটা বিতর্ক চলছে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাজভবন-কালচার জিইয়ে গণতন্ত্র বা আর্থ-সামাজিকস্তরের কোন উপকারটা হচ্ছে? এই পদ বিলুপ্ত হলেই বা দেশের মাথায় কোন আকাশ ভেঙ্গে পড়বে? সেই বিতর্কেই তো ইন্ধন দিচ্ছে এহেন কাজকর্মই৷ সাংবিধানিক কোনও পদাধিকারীর কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ কখনই কোনও ভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।
রাজ্যপালরা সাধারনত ভিনরাজ্যেরই হন৷ যে রাজ্যের দায়িত্ব পান, সেই রাজ্যের রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারনার অভাব থাকাটাই স্বাভাবিক৷ আপ-টু-ডেট থাকতে তিনি নিশ্চিতভাবেই কারো পরামর্শ নেন৷ সেটা স্বাভাবিক৷ এই ‘উপদেষ্টা’-রা প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক স্তরের হতেই পারেন৷ কিন্তু সেই সব পরামর্শ এক্ষেত্রে কতখানি সমৃদ্ধ করছে পরামর্শগ্রহণকারীকে? আদৌ কি সমৃদ্ধ করছে ?

তথাকথিত ‘উপদেষ্টা’-দের সম্ভবত জানা নেই, যাদবপুর বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য হিসেবে যে ক্ষমতা প্রয়োগ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, আচার্যের সেই ‘ক্ষমতা’ আগে কিছুটা থাকলেও এখন আর আইনেই ততখানি নেই। তাহলে পরামর্শদাতারা
আচার্যকে দিয়ে যাদবপুরে বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কী ‘প্রয়োগ’ করাতে চাইছেন? লাগাতর ছাত্র-বিক্ষোভ নিয়ে সম্ভবত ক্রুদ্ধ বা অপমানিত বোধ করেছেন আচার্য৷ কিন্তু ছাত্রদের প্রতিবাদ তো আইনি সীমা এখনও লঙ্ঘন করেনি৷ পড়ুয়াদের এ ধরনের ক্ষোভ বা বিক্ষোভকে কি অগণতান্ত্রিক বা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে? তাহলে সমস্যাটা কোথায় ? উল্টে বরং সমস্যা তৈরি হচ্ছে কলকাতা, যাদবপুর-সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আচার্যের নিজেই বিতর্কে জড়ানো নিয়ে৷ অতীতে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে
অজস্র বিতর্ক হয়তো হয়েছে, কিন্তু কোনও
আচার্যের বারবার এ ধরনের ‘গেট-ক্র্যাশ’ করার এমন নজির তো এ রাজ্যে বা অন্য কোথাও এর আগে কখনও দেখা যায়নি৷ রাজ্যপাল বা আচার্য, যিনিই হোন, তিনি বার বার খুঁচিয়ে বিতর্ক তৈরি করছেন, এতে তাঁর পদের মর্যাদা কি ক্ষুন্ন হচ্ছে না? ভালোভাবে খেয়াল করলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যিনি
আচার্য হিসেবে যেতে চাইছেন, তিনিই “কাজের কাজ” কিছু করতে না পেরে ফিরে আসছেন এবং মন্তব্য করছেন রাজ্যপাল হিসেবে৷ সেক্ষেত্রে এসব নিয়ে পাল্টা রাজনীতি হওয়াই তো স্বাভাবিক।

আরও একটা বিষয় আছে৷ আচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ না-ডাকলেও তিনি নিজের সিদ্ধান্তেই সেখানে চলে যাচ্ছেন। কেন যাচ্ছেন? এতে তাঁর নিজের এবং যে পদের তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন, দু’ক্ষেত্রেরই মর্যাদারই তো অবনমন ঘটাচ্ছেন।
বুঝতে তো একটু অসুবিধা হচ্ছেই যে, কেন একজন আচার্য বার বার রবাহুত হবেন ? আচার্যকে সব বিষয়ে ডেকে আনতেই হবে, এমন যদি কোনও আইন থেকে থাকে, তাহলে সেই আইন লঙ্ঘিত হওয়ার “যুক্তিসঙ্গত ও আইনি” অভিযোগ এনে আইনের পথে যাওয়াই তো উচিত ছিলো৷ তাতে তো আচার্যের মর্যাদা যেমন রক্ষা পেতো, তেমনই ‘পাবলিক ওপিনিয়ন’-ও আচার্যের পক্ষেই যেতো, এখন যার উল্টোটা হচ্ছে৷

আর যদি এমন কোনও আইন-ই না থাকে, তাহলে একজন আচার্য বার বার কোনও না কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সেখানে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টিই বা করবেন কেন ? দেশের আইন কি এ কাণ্ড অনুমোদন করে ?
এটা কোনও আচার্যের পক্ষে মানানসইও নয়। উপাচার্যরা সেনেট বা কোর্ট বৈঠকে আচার্যকে না-ডাকলেও তিনি নিজে থেকে সেখানে হাজির হবেন কোন আইনের ভিত্তিতে? উপাচার্যরা বেপরোয়াভাবে বেআইনি কাজ করে চলেছেন, এটা সম্ভব নাকি? তাহলে নির্দিষ্ট কোন আইনের ভিত্তিতে কোনও একজন আচার্য ধারাবাহিকভাবে অতি সক্রিয় ভূমিকা পালনে উদ্যোগ নিচ্ছেন? কার বা কাদের পরামর্শে এসব করছেন ? কোনও
আচার্যের পদক্ষেপে যদি মনে হয় তিনি যেন সব বিষয়ে অনর্থক বিতর্ক তৈরি করছেন, সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক ৷ যদি মনে হয় বড়সড় অশান্তি বাধানোর চেষ্টা হচ্ছে, তবে সেটা হবে একধরনের প্ররোচনামূলক৷ দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের আচরণ এমন হতে পারেনা৷

রাজনীতিবিদরা হামেশাই কিছু না কিছু বিতর্ক সৃষ্টি করে প্রচার পেতে চান৷ কিন্তু কোনও আচার্যের মধ্যে সব সময়ে একটা প্রচার পাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলে, সেই আচার্যকে রাজনীতিবিদ হিসাবে ধরে নেওয়া হলে, সংবিধান কতখানি লঙ্ঘিত হচ্ছে, ধীরে ধীরে সেই ভাবনাটাই যেন জাঁকিয়ে বসছে৷

দুর্ভাগ্য !

Previous articleবেকায়দায় পড়ে ‘উল্টো’ পোস্ট ভোগলের
Next articleNRC-CAA অস্থিরতার মধ্যেই মিঠে রোদ গায়ে মেখে বড়দিনের উৎসবে মাতোয়ারা তিলোত্তমা