গ্রহণযোগ্য মুখের অভাব প্রকট হচ্ছে ! কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

এই কাজটা এতদিন অমিত শাহ-ই করতেন৷ গত কয়েকদিন যাবৎ সেই কাজটাই করছেন প্রধানমন্ত্রী৷ বাংলার ‘মন বুঝতে’ রাজ্যের বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে পর পর বৈঠক করছেন প্রধানমন্ত্রী৷ ৫-৬ জনের সঙ্গে বসা হয়ে গিয়েছে, বসবেন বাকিদের সঙ্গেও।

হাজারো কাজে ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী৷ CAA-NRC- NPR তো আছেই, দিল্লির সাম্প্রতিক হিংসা নিয়ে বিতর্ক এখনও তাজা৷ চলছে একাধিক মোকদ্দমা৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা-ভাইরাস৷ আন্তর্জাতিক স্তরে একাধিক ইস্যুতে চাপ বাড়ছে ভারতের। পরিস্থিতি সামাল দিতে রোজই বিবৃতি দিয়ে কিছু না কিছু বলতে হচ্ছে বিদেশ মন্ত্রককে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার সিএএ-বিরোধী মামলায় আদালতবান্ধব হিসেবে শামিল পর্যন্ত হতে চেয়েছে। ওদিকে নতুনভাবে চাপ বাড়িয়েছেন ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লা আলি খোমেনই। টুইট করে দিল্লির হিংসার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন ইরানের এই রাষ্ট্রনেতা৷ ওদিকে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি পুরোপুরি তলানিতে না ঠেকলেও একদম ঝিমিয়ে আছে৷ সরকারি সম্পত্তি, সংস্থা বিক্রি করে, ব্যাঙ্ক- ইপিএফে সুদের হার কমিয়ে, বেসরকারি হাতে সরকারি সংস্থার ভার বা মালিকানা তুলে দিয়েও ঘুমিয়ে থাকা অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলা যাচ্ছেনা৷ দলীয় রাজনীতি বা সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও বাজছে হতাশার সুর৷ প্রধানমন্ত্রীর সেই ২০১৪ সালের ভাবমূর্তি তো কবেই ডুবেছে৷ ২০১৯-এর বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতাও এখন বড় প্রশ্ন চিহ্নের সামনে৷ শুধুই পাকিস্তান দেখিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আনার খেলাও ধরা পড়ে গিয়েছে৷ স্রেফ প্রশাসনকে ব্যবহার করে নিজেদের ঠাট-বাট বজায় রাখতে হচ্ছে৷

ওদিকে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের দেরি প্রায় একবছর৷ তাহলে এখনই এত ধরনের জটিল ব্যস্ততার মাঝেও সাত তাড়াতাড়ি বাংলার সাংসদদের সঙ্গে
প্রধানমন্ত্রীর দফায় দফায় বৈঠক করার কারন কি ? ভোট হবে তো বিহারেও৷ ওই রাজ্য নিয়ে তো প্রধানমন্ত্রী এতখানি চিন্তিত বা সিরিয়াস নন! তাছাড়া এ সব বৈঠক তো প্রিলিমিনারি-স্তরের৷ প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন কোনও মন্ত্রী বা দলের কোনও পদাধিকারীকেও তো এই বৈঠকের ভার দিতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী৷ তেমন যোগ্য লোকের অভাব অবশ্যই আছে৷ অরুন জেটলি, সুষমা স্বরাজ নেই৷ ছক কষে রাজনাথ, গড়কডিদের পিছনের বেঞ্চে পাঠানো হয়েছে৷ সেখান থেকে তাঁদের সামনে এনে গুরুত্ববৃদ্ধি করার মতো ‘হারাকিরি’ করবেন না প্রধানমন্ত্রী৷ রাজ্য রাজ্য এ ধরনের কাজে এতদিন উপযুক্ত ভূমিকা নিতেন অমিত শাহ৷ শাহের ব্রিফিং-এর ভিত্তিতেই পদক্ষেপ করতেন প্রধানমন্ত্রী ৷ তাহলে এবার সলতে পাকানোর পর্যায় থেকেই কেন এত সক্রিয় প্রধানমন্ত্রী? শাহের কাজ নিজের ঘাড়ে কেন নিলেন তিনি ?
বাংলার সাংসদদের সঙ্গে
পর পর বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতি এবং বঙ্গ- বিজেপির প্রকৃত অবস্থা শুনছেন প্রধানমন্ত্রী৷ দিনকয়েক আগে অমিত শাহ এবং বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা রাজ্যে এসে বৈঠক করে গিয়েছেন দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে৷ রাজ্য নেতারা এই দুই শীর্ষনেতাকে সব ধরনের কথাই বলেছেন৷ সেই বৈঠকেই তো ধরা গিয়েছে, এ রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে বঙ্গ-বিজেপি ঠিক কী চাইছে দিল্লির কাছে৷ সেই একই কথা ফের কেন শুনছেন প্রধানমন্ত্রী ? তাহলে কী শাহ-নাড্ডা প্রধানমন্ত্রীকে পরিস্থিতি ব্রিফ করেননি ? নাকি, সেই ব্রিফিংকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না প্রধানমন্ত্রী?

রহস্য এখানেই৷ রহস্য একাধিক৷

এক) দিল্লি-ভোট এবং দিল্লি-হিংসা মোকাবিলার দায়িত্বে ছিলেন অমিত শাহ৷ দু’টি ক্ষেত্রেই ল্যাজে-গোবরে হতে হয়েছে বিজেপিকে৷ ভোটে দলের স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণে একের পর এক ভুল করেছেন শাহ৷ এক আঞ্চলিক দলের নেতার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী-সহ গোটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা, ৯জন মুখ্যমন্ত্রী, গোটা দেশ থেকে তুলে আনা বাছাই করা হাজারখানেক নেতাকে দিল্লিতে নামিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে মহীরুহ বানিয়ে দিয়েছিলেন শাহ৷ কেজরি এত নম্বর পাওয়ার যোগ্য নন৷ শাহ নিজে সব কাজ ছেড়ে দিল্লি নিয়েই ছিলেন৷ তবুও কাজের কাজ কিছু হয়নি৷ বিজেপির ঝুলিতে যায় ৭আসন৷

দুই) দিল্লি-হিংসা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৷ অথচ দিল্লির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত এই শাহই৷ পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্দেশ দিয়ে আসরে নামান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে৷ নিজে ফোনে এবং সরাসরি কথা বলেন কেজরির সঙ্গে৷ ততদিনে বিশ্বজুড়ে ভারতের যতখানি ফেস-লস হওয়ার হয়ে গিয়েছে৷

এবং ততদিনে নিজের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যোগ্যতা সম্পর্কেও স্বচ্ছ একটা ধারনাও তৈরি হয়ে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর৷ তিনি সম্ভবত বুঝেছেন
তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা ‘দক্ষিণহস্ত’-র চেহারার সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মস্তিষ্কের ফারাক আছে৷ আসলে সরকারি ক্ষমতার জোরে, সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে এদেশে কংগ্রেস-সহ প্রায় সব দলে সব সময়ে কিছু সুপার-লিডার দেখা গিয়েছে৷ ক্ষমতা অন্তর্হিত হলে যাদের আর খোঁজ মেলেনি৷ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই গোত্রের কি’না, তা ইতিহাস বলবে৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আর ঝুঁকি নিতে রাজি নন৷ তাই দেশের মানচিত্রে গেরুয়া রংয়ের পরিধি বাড়াতে নিজের হাতেই স্টিয়ারিং নিয়েছেন৷ বঙ্গের বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকেই লিখিত ভাবে বেশ কিছু প্রস্তাব ও পরামর্শ প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন৷ ৬ জন সাংসদ ইতিমধ্যেই তা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলেও দিয়েছেন। কথা হয়েছে
বাংলার সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের ‘এবিলিটি’ নিয়েও৷ বঙ্গ-বিজেপির অন্দর যে পুরোপুরি ‘সুস্থ’ নয়, তাও জেনে নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী৷ ‘ওয়ান টু ওয়ান’ অনেক বিস্ফোরক কথা বলার ‘সাহস’ও সাংসদরা পাচ্ছেন৷

একাধিক রাজ্যের বিধানসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি জোর ধাক্কা খেয়েছে। দিল্লির ভোটের ফল সম্ভবত এখনও মানতে পারেননি তিনি৷ ২০২০-এ ভোট হতে পারে বিহারে। ২০২১-এ ভোট হতে পারে বাংলায়। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে দল জিততে পারলে, তাঁর হারিয়ে হওয়া ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ফিরবে বলে নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রী৷ এটাই এখন একমাত্র লক্ষ্য তাঁর৷

আর এই ‘মিশন’-এ তিনি ফের বেলতলায় না যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ সে কারনেই শত ব্যস্ততার মাঝেই প্রধানমন্ত্রী সময় বার করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ নিরুপায় তিনি, গোটা দেশের বিজেপি কর্মী, সমর্থক, ভোটাররা তো একমাত্র তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন৷ সেই আশা ও ভরসার মর্যাদা তো প্রধানমন্ত্রীকে দিতেই হবে৷

ভরসাযোগ্য, দক্ষ, বিচক্ষণ এবং সর্বজনের কাছে গ্রহনযোগ্য মুখের অভাব কি সত্যিই প্রকট হয়ে উঠছে গেরুয়া শিবিরে !

Previous articleমুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জলাভূমি ভরাটের অভিযোগ
Next articleরবীন্দ্রভারতী কাণ্ডে অভিযুক্তদের নিয়ে চন্দননগর কলেজেও নিন্দার ঝড়