নীল নদী, সবুজ বন, হলুদ রোদ…সাতকোশিয়া

দুবার তারকেশ্বর, একবার তারাপীঠ। এগারো বছরে তেমন ভাবে কোথাও তেনাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। বছরের অন্য সময়ে যেমন তেমন। বিবাহবার্ষিকী এলেই আক্রমনের ঝাঁঝ তীব্র হয়।কপাল ঠুকে তাই কথা দিয়ে দিয়েছিলাম এবারে বিবাহবার্ষিকীর নিশি যাপন আর চেনাশোনা চৌহদ্দির মধ্যে নয়, দূরে কোথাও… সাতকোশিয়া নামটি এসেছে সাত ক্রোশ থেকে।মহানদীর প্রবাহ পথে সাত ক্রোশ অভয়ারণ্যের অপভ্রংশ সাত কোশিয়া। গোটা এলাকা পূর্বঘাটে ঘেরা তাই এর নাম সাতকোশিয়া গর্জ।সাতকোশিয়ার সবথেকে কাছের রেল স্টেশন হল অঙ্গুল। অঙ্গুল থেকে সাতকোশিয়া ঘন্টাখানেকের দূরত্ব। নির্দিষ্ট দিনে বাড়ি-ঘর , মা কালীর জিম্মায় রেখে রাতের ট্রেন ধরে অঙ্গুল পৌঁছান গেল ভোর পাঁচটায়। স্টেশনে একটি নিজস্ব গাড়ি ভাড়া করে চাকা গড়িয়ে দেওয়া গেল পিচ কালো রাস্তায়। সুন্দর রাস্তা। সিঁদুর পড়লে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নেওয়া যায়। কিছুদূর এগোতেই বিদায় নিল সভ্যতা। গাড়ির রেডিওতে তখন স্থানীয় ভাষার গান। মানে বুঝলাম না। আগের রাতে ট্রেনে ঘুম হয়নি ঠিক মতো। তাই গাড়িতে একটু ঝিমুনি। সাত কোশিয়ায় পৌঁছিয়ে এবার অবাক হওয়ার পালা। নীল নদী, সবুজ বন, ধূষর পাহাড়, হলুদ রোদ। বসের গালাগালি, ফাইলের চাপ, সহকর্মীদের কাঁকড়া ক্রিয়া, সব যেন আবছা হয়ে এল। পর্যটকদের সক্রিয়তা বাড়ানোর জন্য বন উন্নয়ন দফতর নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্বঘাটের গা চিরে বয়ে গেছে মহানদী। আর সেই মহানদীর চর থেকে শুরু করে পাহাড়ের গা পর্যন্ত ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়েছে এসি কটেজ, এবং তাঁবু। থাকাটা আপনার নিজের রেস্তো বুঝে। সাতকোশিয়ায় আপনার জন্য টিকড়পাড়া নেচার ক্যাম্প। সামনেই মহানদীর চর। নানান বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে নদী পারে। চারপাশের জঙ্গল জুড়ে হাতি, গাউর, লেপার্ড, ভালুক, হরিণের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। সকালের কুয়াশামাখা সাতকোশিয়া রোমান্টিকতায় সেরা। মহানদী যেন এক রূপোর ফিতে। যতদূর চোখ যায় বালি আর বালি। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে মাইকার জন্য। নিস্তব্ধতা ছিড়ে ফেলছে পাখির ডাক। কতগুলিকে চিনলেও বেশীর ভাগই অচেনা। সাতকোশিয়া নামেই টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট। বাঘ নেই বটে। তবে প্রাণীর বৈচিত্র চোখে পড়ার মতন। মহানদীর মিষ্টি জল ঘড়িয়ালের বেশ পছন্দ। তাই পার থেকে দেখতে পারেন মোবাইল খ্যাচাং এ গ্যালারি ভরাতে পারেন। তবে সাহস দেখিয়ে নদীতে স্নান করতে নামবেন না। এরপর খাওয়া দাওয়া করে ভেসে পড়ুন মহানদীর বুকে। ঘন্টা খানেক সময় কাটিয়ে ফিরে আসুন কটেজে। সেখানে আপনার মনোরঞ্জনের জন্য জলশার ব্যবস্থা থাকবে। এরপর লবঙ্গির জঙ্গল, পুরানাকোঠীর নজরমিনার। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার জঙ্গলে গেলে দয়া করে একজন গাইড নিয়ে নেবেন। গভীর জঙ্গলে সবুজের গায়ে আলপনা আঁকে হাজারও রঙবেরঙের প্রজাপতি। চারপাশে এমন এক পরিবেশে সবুজের মাঝে তিরতির করে পাহাড়ি ঝোড়া। আপনার মনে তখন প্রেমের ভায়োলিন বাজছে। সন্ধ্যার মুখে মহানদীর জলে আবির গোলে সূর্য। সূর্যাস্তের সাথে সাথেই এখানে আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তন হয়। শীতের শির শিরে ঠান্ডা হাওয়া আর ওই লালচে কমলা আকাশ, আপনি ভুলে যাবেন নিজেকে। এমন সময় সূর্য ডুবল টুপ করে। এমনিতে আমার গিন্নি মহিলাটি বেশ জাদরেল। এগার বছর পার করে মহানদীকে সাক্ষী মেনে বললেন ভালোবাসি তোমাকে।

কীভাবে যাবেন:

  • শনিবার টার্গেট করে সম্বলপুর এক্সপ্রেস ধরাই ভালো।
  • অঙ্গুল স্টেশন থেকে সাতকোশিয়া যাওয়ার সুবিধা হবে।
  • অঙ্গুল থেকে নিজেদের জিম্মায় একটি গাড়ি নিয়ে নেবেন।

কোথায় থাকবেন:

  • সাতকোশিয়া থাকার বা ঘোরার জায়গা প্রধানত চারটে, টিকরপাড়া, ছোটকেই, পুরুনাকোটে আর লবঙ্গী।
  • টিকরপাড়ার জন্য একদিন অবশ্যই বরাদ্দ রাখবেন
  • উড়িষ্যার বন দফতরের থাকার জায়গা রয়েছে। বুকিং এর জন্য www.satkosia.org

হোটেল সন্ধান:

হোটেল আপনার রেস্তো বুঝে। এখানে একহাজার থেকে আড়াই হাজারের মধ্যে কিছু হোটেলের সন্ধান দেওয়া হল।

  • সাতকোশিয়া হিল ভিউ রিসোর্ট-9437027974
  • সাতকোশিয়া টাইগার রিজার্ভ – 9437279340
  • সাতকোশিয়া স্যান্ড রিসোর্ট- 9437279340
  • সাতকোশিয়া নেচারক্যাম্প, টিকরাপাড়া – 08658023333
  • হোটেল আশিয়ানা হিল ভিউ – 070644 26015
  • হোটেল শক্তি – 06764 234 888

সাতকোশিয়া কুলীন গোত্রে উঠে আসেনি এখনও। এখনও নাগরিক স্বাচ্ছন্দ পাবেন না মহানদীর এই পর্যটন কেন্দ্রে। মোটের ওপর আরামদায়ক ভ্রমণ স্থান নয় মোটেই। তাই অনাঘ্রাতা। আর এটাই সাতকোশিয়ার ইউএসপি। ভীড় কখোনই আপনার বিরক্তির কারণ হবে না। একটু নিরালায় জল-জঙ্গলের সঙ্গে পাহাড়ের গল্প। নিজেকে খুঁজে পেতে একবার ঘুরে আসতেই পারেন। আরাম পাবেন।

 

Previous articleকরোনা সতর্কতা: রাজ্যে ২০০কোটি টাকার ফান্ড, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিমা ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর
Next articleইতিহাসের বাংলা ঘড়ি, ভীম নাগের দোকানে