কংগ্রেসের অন্দরে বিজেপির- এজেন্ট কারা! কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

একটি চিঠি এবং সেই চিঠি ফাঁসের রহস্য ঘিরে জাতীয় কংগ্রেসের অন্দরে বেনজির কাণ্ড ঘটতে চলেছে৷ পরিস্থিতি এমনই, হয় কংগ্রেস ফের ভাঙ্গতে পারে, অথবা গান্ধী-পরিবার পাকাপাকিভাবেই সরে যেতে পারে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ পদ থেকে৷

প্রকাশ্যে দলের ফাটল এখনও দেখা যায়নি ঠিকই, তবে AICC-র সূত্রের খবর, ওই চিঠি ঘিরে ইতিমধ্যেই আড়াআড়িভাবে দুই শিবির হয়ে গিয়েছে জাতীয় কংগ্রেস ৷ একদিকে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, মনমোহন সিং, এ কে অ্যান্টনি, আহমেদ প্যাটেল, তিন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহ, অশোক গেহলট, ভূপেশ বাঘেল, লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরি, সিদ্দারামাইয়া, ডি কে শিবকুমার, কুমারী সেলজা-রা৷

আর অন্যদিকে আছেন, গুলাম নবি আজাদ, কপিল সিব্বল, আনন্দ শর্মা, শশী থারুর, মণীশ তিওয়ারি, বীরাপ্পা ময়লি, রেণুকা চৌধুরি, জিতিন প্রসাদ, মিলিন্দ দেওরার, সন্দীপ দীক্ষিত, ভূপেন্দর সিং হুডা, পৃথ্বীরাজ চৌহান, রাজিন্দর কাউর ভট্টলের মতো দলের শীর্ষ নেতারা৷

এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই সোমবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডাকা হয়৷ আর সেখানেই বোমা ফাটিয়েছেন রাহুল গান্ধী৷ আশা করাই যায়, বৈঠকে দায়িত্ব নিয়েই ওই ‘মারাত্মক’ মন্তব্যটি করেছেন রাহুল৷ একঝাঁক অভিজ্ঞ নেতাদের মাঝে বসে ‘অসত্য’ বলে দলের অন্দরে বিতর্ক তৈরি করার ঝুঁকি অনেক৷ সেই ধাক্কা সামলাতে রাহুল কতখানি যোগ্য, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷

সোমবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের শুরুতেই রাহুল গান্ধী বলে বসেন, “চেয়ারপার্সন পদে বদল চেয়ে দলের যে সব নেতা সোনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখেছেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই বিজেপির যোগ আছে।’’

ভয়ঙ্কর অভিযোগ সন্দেহ নেই৷ যে দলটি দেশজুড়ে বিজেপির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে চলেছে, জনতার মনে যখন দৃঢ়ভাবেই গেঁথে আছে যে, কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ দল৷ দেশজুড়ে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির জবরদস্ত প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে এই কংগ্রেস দলই৷ ঠিক সে সময় রাহুল গান্ধী বলে দিলেন, কংগ্রেসের শীর্ষস্তরে “বিজেপির এজেন্টরা” সক্রিয়ভাবেই কাজ চালাচ্ছে৷

স্বাভাবিকভাবেই দলের অন্দরে এ কথায় প্রবল টানাপড়েন শুরু হয়েছে৷
রাহুল গান্ধী কারো নাম করেননি ঠিকই, কিন্তু হঠাৎই এই ইস্যুতে ‘ফুঁসে’ উঠেছেন দলের দুই শীর্ষনেতা, গুলাম নবি আজাদ এবং কপিল সিব্বল৷ ওই মন্তব্যের প্রতিবাদে রাহুল গান্ধীকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করে আজাদ বলেছেন, “বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ প্রমাণিত হলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব।’’ সিব্বল তো বৈঠক চলাকালীনই টুইট করে দলের কোন্দলের কথা ‘পাবলিক’ করে দিয়েছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘রাহুল গান্ধী বলছেন আমাদের সঙ্গে বিজেপির আঁতাত রয়েছে। রাজস্থান হাইকোর্টে কংগ্রেসকে বাঁচিয়েছি। মণিপুরে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে দলের লড়াইয়ে পাশে থেকেছি৷ গত ৩০ বছর বিজেপির সমর্থনে একটা কথাও বলিনি। তবুও বিজেপির সঙ্গে আমাদের আঁতাত? ’’

কংগ্রেসের অন্দরে কে বা কারা বিজেপি’র এজেন্ট, তা খুঁজে বার করার দায়িত্ব ওই দলের৷ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এত কথা থাকতে খোদ রাহুল গান্ধী কেন দলের একঝাঁক শীর্ষ নেতাদের দিকে আঙুল তুলে তাদের বিজেপি’র ‘বন্ধু’ বললেন ? একেবারে ভিত্তিহীন কথা ওইস্তরের বৈঠকে বলা সম্ভব নয়৷ সেক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া যায়, কংগ্রেসের প্রাক্তণ সভাপতির হাতে এই অভিযোগের কিছু না কিছু প্রমাণ রয়েছে৷ নাহলে, এভাবে রাহুল গান্ধী তোপ দাগতে পারেন না৷

এই বিতর্কের সূত্রপাত একটি চিঠি এবং সেই চিঠি ফাঁসের রহস্য ঘিরে৷ কংগ্রেসের চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধীর অসুস্থতার সময়ই দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি তুলে ২৩ জন নেতা চিঠি দেন সোনিয়াকে৷ চিঠি গোপন ছিলো, তাই কেউ জানতেই পারেনি, কোন নেতারা সোনিয়া গান্ধীকে চেয়ারপার্সন পদ থেকে সরাতে চাইছেন৷ এই চিঠি পাওয়ার পরেই সোনিয়া দলের শীর্ষ পদে থাকতে অস্বীকার করেন৷ এবং দায়িত্ব ছাড়ার কথা জানিয়েও দেন৷

এইখানেই সম্ভবত খারাপ লেগেছে রাহুলের৷ রাহুল সভাপতি পদ থেকে সরে যাওয়ার পর সোনিয়া গান্ধী নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই দলের অন্তর্বর্তী-চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ প্রায় এক বছর কংগ্রেস দল চলেছে অন্তর্বর্তী- সভাপতির নেতৃত্বে৷ একাধিকবার তিনি পদ ছাড়ার কথা বলেছেন৷ রাহুলকে দলের দায়িত্ব নিতেও বলেছেন৷ কিন্তু রাহুল গান্ধী রাজি না হওয়ায়, সোনিয়া বাধ্য হয়েই পদে থাকেন৷ কারন, দলের সভাপতি নির্বাচন এখন সম্ভব নয়৷ এই নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২২ সালে৷ এর মাঝে যিনিই দায়িত্ব নিন, তাঁকে অন্তর্বর্তী- সভাপতিই হতে হবে৷ ওদিকে, এর মাঝেই একাধিকবার অসুস্থ হয়ে পড়েন সোনিয়া ৷ হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত হতে হয় তাঁকে৷ ওই অসুস্থতার মাঝেই দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি তুলে ২৩ নেতা চিঠি ধরান সোনিয়া গান্ধীকে৷ এটাই রুষ্ট করেছে রাহুলকে৷

দলের শীর্ষপদে পরিবর্তন যারা চেয়েছেন, তাদের বক্তব্য, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রের নির্দিষ্ট ধারা বলছে, অন্তর্বর্তী সভাপতির মেয়াদ সর্বাধিক এক বছর পর্যন্ত হতে পারে। সোনিয়া গান্ধী এক বছরের বেশি ওই পদে আছেন৷ সুতরাং এই পদে এভাবে কারো বসে থাকা ‘দলীয় গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী’৷ দলের গঠনতন্ত্র উল্লেখ করে এই অংশের মতে, যদি কংগ্রেস সভাপতির মৃত্যু হয় অথবা তিনি ইস্তফা দেন তাহলে AICC-র প্রবীণতম সাধারণ সম্পাদককে অস্থায়ী ভাবে সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে স্থায়ী সভাপতি নির্বাচন করতে হবে। ২৩ নেতার বক্তব্য,
“গঠনতন্ত্র অনুসারেই দলের শীর্ষতম পদে বদল চেয়ে তাহলে আমরা অন্যায় কী করেছি?”

এদিকে, দলের যে ২৩ নেতা বদল চেয়ে চিঠি দিয়েছেন, সোমবার রাহুল তোপ দেগেছেন তাঁদের বিরুদ্ধেই৷ বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার গুরুতর অভিযোগ রাহুল এনেছেন যাদের বিরুদ্ধে, তাঁরা সম্ভবত ওই ২৩ জনের মধ্যেই আছেন৷ কারণ এই নেতারাই দাবি করেছেন দলে ‘ফুল টাইমার” সভাপতি দরকার। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে নির্বাচনেরও দাবি তোলেন তাঁরা। এই ২৩ নেতার এ ধরনের তৎপরতার পিছনে বিজেপি’র হাত আছে বলেই সম্ভবত মনে করেছেন কংগ্রেসের প্রাক্তণ সভাপতি৷

সোনিয়া গান্ধীকে লেখা ২৩ নেতার সেই চিঠি এতদিন গোপনই ছিলো৷ আচমকা রবিবার সেই চিঠি ফাঁস হয়ে যায়। তখনই পাল্টা চাপ বাড়িয়ে সোনিয়া গান্ধী জানান, তিনি দ্বিতীয় দফায় সভানেত্রীর পদ গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি জানান, কংগ্রেস নেতাদের অনুরোধেই ২০১৯-এর ১০ আগস্ট তিনি অন্তর্বর্তী সভানেত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তখনই শর্ত দিয়েছিলেন, নতুন সভাপতি দ্রুত ঠিক করতে হবে৷ ২৩ সাংসদের চিঠির খবর প্রকাশ্যে আসতেই একাধিক হেভিওয়েট নেতা, যার মধ্যে আছেন তিন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহ, অশোক গেহলট, ভূপেশ বাঘেল-সহ অনেকেই সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীকে জানান, পরিবর্তনের এখনই প্রয়োজন নেই৷ সোনিয়া গান্ধীর লিডারশিপে তাঁদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।

এইখানেই বোধহয়’শক্তি’ পেয়েছেন রাহুল গান্ধী৷ আর তার জোরেই কংগ্রেসের অন্দরে “বিজেপির-এজেন্ট” খুঁজে পেয়েছেন তিনি৷

তবে প্রশ্নও উঠেছে৷ দলের স্বার্থে রাহুল গান্ধীর এখনই উচিত দলের ভিতরে থাকা ‘বিজেপির বন্ধু’-দের নাম প্রকাশ্যে আনা৷ তা না করার অর্থ, কংগ্রেসের ক্ষতি করা৷

এখন দেখার এই জল কতদূর গড়ায় ৷

Previous articleধোনির আরও উপরের দিকে ব্যাট করা উচিত ছিল, মন্তব্য সৌরভের
Next articleগর্ভবতী মহিলার ফ্যালোপিয়ান টিউবে করোনার আক্রমণ! হল গর্ভপাত