নতুন বছরের শপথ: নারী-পুরুষ নয়, মানুষ তৈরি হোক

নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়

নতুন বছরে সবাই শপথ নেয়; বিভিন্ন ধরনের অঙ্গীকার। কিন্তু আমি চাই এই ২০২১-এ বাবা-মায়েরা অঙ্গীকার করুন তাঁরা সন্তান মানুষ করবেন; ছেলে কিংবা মেয়ে নয়। কারণ ছেলে-মেয়ের এই বিভেদ ছোটবেলা থেকে একটি শিশুর মনে তার ভবিষ্যতের কাজের গতি-প্রকৃতি নির্দিষ্ট করে দেয়। আমার নিজের ঘটনা থেকে মনে হয়েছে, এই শতাব্দীতে এসেও মেয়ে মানেই সে পুরুষের অধীনে থাকা তার সম্পত্তি বলে ধরা হয়। আনন্দপুরে (Anandapur) সেই অভিশপ্ত রাতে আমি যাঁকে উদ্ধার করেছিলাম সেই যুবতীটি কিন্তু বাইরের কেউ নয় নিজের বয়ফ্রেন্ডের (Boyfriend) কাছ থেকেই চূড়ান্ত শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আমি সেদিন ফিরছিলাম আমার বাপের বাড়ির অনুষ্ঠান থেকে। সঙ্গে ছিলেন আমার স্বামী দীপ শতপথী (Deep Satpathi)। যিনি সব কাজে, সবসময় আমার পাশে থেকে সাহস যোগান। আমাদের গাড়িটা দেখতে পেয়ে আনন্দপুর মোড়ে নিজের গাড়ি থেকে নেমে ওই যুবতী “বাঁচাও বাঁচাও” করে চিৎকার করছিলেন আর কাঁপছিলেন। গাড়ি থামিয়ে কাছে গিয়ে দেখি তিনি রক্তাক্ত। তখন কিন্তু আমি একবারও ভাবিনি এরপরে কী হতে পারে? এমনকী চিরজীবনের জন্য আমার পা-টা যে কমজোরি হয়ে গেল সে আশঙ্কাও তখন একবারও মনে আসেনি। মনে এসেছিল একটাই কথা, একটি মেয়ে একা বিপদে পড়েছে তাকে বাঁচাতে হবে। কারণ, এটাই আমার বাড়ির শিক্ষা। ছোটবেলা থেকে আমি এভাবেই বড় হয়েছি। অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করা। অসহায় মার খেলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো- এটাই শিখেছি বরাবর।

আমার বাবা-মা কিন্তু ছেলে-মেয়ের মধ্যে কোনো বিভেদ করেননি। আমিও আমার কন্যাকে মানুষ হিসেবে বড় করে তোলার চেষ্টা করেছি। সেই কারণেই আজ আমার এই লড়াইয়ে সেও আমার সঙ্গী। একসময় গার্হস্থ্য হিংসার (Domestic Violence) শিকার হয়েছিলাম। শিশুকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে সে লড়াই লড়েছি দীর্ঘদিন। তখনকার অভিজ্ঞতা থেকে বলব, যত উচ্চশিক্ষিত-অভিজাত পরিবারে হোক না কেন তাতেই যে জ্ঞানচক্ষু খুলবে তা কিন্তু নয়। সে পরিবারেও নারী শুধুমাত্র পুরুষের সঙ্গিনী তার সমানে দাঁড়িয়ে মর্যাদা পাওয়া মানুষ নয়।

হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে যখন ফাটা মাথা আর ভাঙা পা নিয়ে শারীরিক যন্ত্রনায় দগ্ধ হয়েছি, তখন শুধু একটাই কথা মনে হয়েছে কলকাতার ইতিহাস যখন লেখা হবে তখন কোথাও না কোথাও এই ঘটনার কথাও থাকবে। হয়তো নাম থাকবে আমারও। আমি যে কাজটা করেছি সেটা যে স্বীকৃত হয়েছে এই তৃপ্তি আমার শারীরিক যন্ত্রণা অনেকটা উপশম করেছে। এই পরিস্থিতিতে পাশে পেয়েছি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পাশে দাঁড়িয়েছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা থেকে শুরু করে অন্যান্য পুলিশ আধিকারিক কর্মীরা। আর এদের দেখলেই মনে হয় যে আলো নিভে যায়নি। শুধু একটা আলো থেকে আর একটা আলো জ্বালিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। তাহলেই আলোকিত হয়ে উঠবে নতুন বছরের দিনগুলো।

অনেকে প্রশ্ন করেছেন, পরে যখন জানতে পারলাম ওই যুবতী ছেলেটির প্রেমিকা এবং সামনে তাদের বিয়ে হওয়ার কথা তখন আমার কেমন লেগেছিল? আমি তাঁদের বলতে চাই, একটি মেয়ে আক্রান্ত- সেটা যার দ্বারাই হোক না কেন সেই অসহায় অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করাটাই লক্ষ্য। কী পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হচ্ছে সেটা বড় কথা নয়। সে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করাটাই কাজ, আর আমি শুধু সেই কাজটাই করেছি।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ইদানীং ভোটের ময়দানে অনেক টানাটানি চলছে দেখছি। কিন্তু সত্যি কি রবীন্দ্রনাথকে আমরা আত্তিকরণ করতে পেরেছি? যদি তাই হত, তাহলে কত বছর আগে তিনি লিখেছেন “নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী, আমি চিত্রাঙ্গদা” কেন সেই কথাটাকে আমরা এখনো বুঝতে পারলাম না, মর্যাদা দিলাম না।

নতুন বছরের প্রথম দিনে আমার একটাই আবেদন, কাউকে বেশি কাউকে কম নয়; সবাইকে সমান মর্যাদা দিন। শিশুকে ছোটবেলা থেকেই শুধু পুরুষ বা নারী বলে লালন-পালন করবেন না। হতেও তো পারে সে বড় হয় সে অন্য কোনো পরিচয় খুঁজে নিতে চাইবে। সেই পরিসরটা তো তাকে দিতে হবে। তাই একজন মানুষ গড়ে তুলুন। যে দেশ গঠন করবে সমাজের ধারক ও বাহক হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন: সাফল্যে মোড়া বছরকে বিদায় জানাল মোহনবাগান

Previous articleদামের দাপটে ফাঁকা বিদেশি মদের দোকান, রমরমা বাজার তাড়ির
Next article২০২০ অনেক শিক্ষা দিয়েছে, নববর্ষের শুভেচ্ছাতেও রাজ্য সরকারকে তোপ রাজ্যপালের