লকডাউনে ঘরে ফেরার গান

উৎপল সিনহা

( এক শ্রমিকবন্ধুর ভাষ‍্য )

আমার একদিকে রেললাইন, অন‍্যদিকে রাজপথ। একদিকে সামান্য উঁচু জমি। অন‍্যদিকে সমতল। আর, মাঝখানের যে আলতো ঢালু জমি, যেখানে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি যখন তখন, আমার ছেলেবেলার অনেক কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার শৈশবের গ্রাম, পুকুর, গাছপালা, ঘাসফড়িং, আলপথ, নগর সংকীর্তন, অষ্টপ্রহর নামগান।

আমি তো হাঁটছি। কয়েকদিন ধরেই একটানা হেঁটেই চলেছি। ঘরে ফেরার পথটা যে এতো দূর, এতোটা দূর, তা আগে কখনও বুঝি নি। আমি তো দলছুট। একা। আমার শুধু হাঁটা, হেঁটেই চলা একটানা।

‘ আমি পথ যে চিনি না, চলিতে পারি না, তোমার আলোর স্বর্গে নিয়ে যাও…’।

জামা ছিঁড়ে গেছে। অল্প কিছু জিনিস ভরা হাতল ভাঙা তোবড়ানো যে বাক্সটা আমার নিত‍্যসঙ্গী সেটাও চুরি গেছে গত রাতে। অভাবে, উদ্বেগে, আতঙ্কে শ্বাসরোধ হয়ে আসে।

এখন এইমুহূর্তে হাতে আর একটাও পয়সা নেই। একেবারে কপর্দকশূন‍্য, নিঃস্ব।

‘ lord I,m five hundred miles away from home… ‘
এখন লকডাউন। সারাটা দেশ স্তব্ধ, অচল। গোটা দেশটা যেন একেবারে নাজেহাল, জবুথবু হয়ে থম মেরে গেছে। ট্রেন নেই, বাস নেই, কোনো গাড়িঘোড়া নেই শুনশান রাস্তা গুলোতে। মালবোঝাই দু’চারটে লরি যাওবা যাতায়াত করছে সারাদিনে, তারা আবার এতো বেশি ভাড়া চাইছে মাত্র কয়েক মাইল পৌঁছে দিতে যে সেটা আমার মতো মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর, আমাকে তো যেতে হবে হাজার মাইল!

আমি হাঁটছি আর হাঁটছি। অস্থায়ী আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি গাঁ-ঘরের পথে। পড়ে রইলো আমার গাঁইতি শাবল, পড়ে রইলো ছেনি হাতুড়ি। পড়ে রইলো বেলচা কোদাল, আরও কত কি। চলতে চলতে খিদে পায় খুব, শরীর ঝুঁকে আসে ক্লান্তিতে। অবসন্ন লাগে। রাস্তার ধারে গাছতলায় শুয়ে পড়ি। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। ‘ আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী ব‍্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি…’।

আমার ছোট্ট ছেলেটার মুখ মনে পড়ে। ও পড়াশোনাটা খারাপ করে না, বুদ্ধিও আছে, কিন্তু, ওর শরীরে পুষ্টি নেই তো, তাই একটু রোগা, একটু দুর্বল আমার ছেলেটা। আর, ওর মা ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত থাকে সবসময়। কি হবে ছেলেটার? কীভাবে মানুষ হবে ও? তাই তো আমি ঘরের টান উপেক্ষা ক’রে, আমার সাধের গাঁ-ঘর ছেড়ে মন পাথরের মতো শক্ত ক’রে বেরিয়ে পড়েছি দূরপথে, এসে পড়েছি হাজার মাইল দূরের ভিনরাজ‍্যে। আমিও যে চাই, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।
পেরিয়ে যাই গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর। কোনোদিন খাবার জোটে, কোনোদিন জোটে না। অট্টালিকা, রাজপ্রাসাদ, স্বপ্নমহল, টিনের চালা, মাটির দেওয়াল, খোড়ো কুটির সব মিলেমিশে একাকার পথের দু’ধারে। কখনও আবার মাইলের পর মাইল শুধু গাছ আর গাছ, জল আর জল, ঘাস আর ঘাস। আহা, ঘাস শুধু ঘাস! এখানে কেন্দ্রও নেই, রাজ‍্যও নেই। ধূধূ প্রান্তর। ‘ প্রান্তরের গান আমার… ‘। একেবারে নৈরাজ্য! না খেয়ে হাঁটো। খিদে ও তৃষ্ণায়, ক্লান্তি ও অবসাদে বেঁকেচুরে নুয়ে পড়ে জীর্ণ শরীরটা। তখন একেকবার মনে হয়, রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়লে কেমন হয়? অথবা, রাজপথে লুটিয়ে পড়লে? এই প্রায় দলা পাকানো দুর্বল শরীর, আর, চৌচির ধমনীগুলোকে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি তো যে কোনো মুহূর্তেই আমি দিতে পারি।

কিন্তু, আমাকে ঘরে ফিরতে হবে যে। ওরা সবাই যে বড়ো আশা নিয়ে শুধু আমি একদিন ঘরে ফিরবো বলেই অর্ধাহারে, হয়তো বা অনাহারেও দিনের পর দিন নিদ্রাহীন! আমিও হাঁটছি আর হাঁটছি শুধু ওদের মুখ চেয়েই। আমার তো রেললাইন আছে, রাজপথ আছে,
‘But I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep ‘

আরও পড়ুন- Weather Forecast: গরমের দাবদাহে স্বস্তির বৃষ্টি! সুখবর শোনাল আবহাওয়া দফতর

 

 

 

Previous articleWeather Forecast: গরমের দাবদাহে স্বস্তির বৃষ্টি! সুখবর শোনাল আবহাওয়া দফতর
Next article‘আসানসোলের মিটারবক্স উঁচুতে থাকায় লোডশেডিং করতে পারেননি,’ শুভেন্দুকে কটাক্ষ দেবাংশুর