যিনি শেখান আলোর গান, উৎপল সিনহার কলম

”বিজয় দৃঢ় স্বরে বললে, ‘ আমি গুরুবাদ মানি না। ‘
শিবনাথ শাস্ত্রীও বলেছিল সেই কথা। গুরু লাগবে কিসে? আত্মবলে ঈশ্বর লাভ করবো। আমি কি কিছু কম?

ঠাকুর একবার তাকালেন গঙ্গার দিকে। দেখলেন হাতের কাছেই সুস্পষ্ট উদাহরণ। চলন্ত স্টীমারের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা গাধাবোট। স্টীমারের সঙ্গে-সঙ্গে গাধাবোটও দিব‍্যি জল কেটে এগিয়ে আসছে পারের দিকে।

ঐ দেখ ঐ গাধাবোট। ওর সাধ‍্য ছিল আত্মবলে এত তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসতে? হয়তো এক বেলা লেগে যেত। ভাগ‍্যক্রমে স্টীমারের সঙ্গে বাঁধা পড়েছিল বলেই এত বেগে বেরিয়ে আসতে পারছে।
গাধাবোটের পক্ষে পার পেতে হলে শুধু আত্মবলে চলে না, গুরুবল লাগে।
জীবমাত্রই গাধাবোট। শুধু লগি ঠেলে- ঠেলে কত আর তুমি এগোবে — কত দিনে?
স্টীমার ধরো। ধরো গুরু। ধরো পারাপারের কর্ণধার। ঠিক তোমাকে পার করে দেবে। ‘ গু ‘ মানে অন্ধকার আর ‘ রু ‘ মানে আলোর দ‍্যোতক। অন্ধকার থেকে যিনি আলোকে নিয়ে যান তিনিই গুরু। অন্ধকারে যিনি আলোর সংবাদ দেন তিনিও।
এত বড় যে বিদ‍্যা-বিশারদ হয়েছো, বলি, বর্ণপরিচয় শিখতে গুরু লাগে নি? ”
( পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ : অচিন্ত‍্যকুমার সেনগুপ্ত )

আস্তিক, সংশয়বাদী ও নাস্তিক নিয়ে গড়া এই বিপুল বিশ্বসংসারে যে সমস্ত তর্কের আজও ইতি ঘটে নি অর্থাৎ কোনো সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসে নি তার মধ‍্যে অন‍্যতম প্রধান দু’টি তর্কের বিষয় হলো, ‘ আছে ‘ নাকি ‘ নেই ‘ এবং ‘ চাই ‘ নাকি ‘চাই না ‘।

আস্তিকেরা বলেন এ জগৎ ঈশ্বরময়। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। নাস্তিকেরা বলেন এ জগতে ঈশ্বর ব’লে কিছু নেই। গ্রহ নক্ষত্র মাটি জল গাছপালা ও প্রাণীকুল সবই বিবর্তনের ফল।

আরেকটি তর্কের বিষয় জীবনে গুরুর গুরুত্ব। একদল, যাঁরা ঈশ্বর মানেন না তাঁরাও কিন্তু এই প্রশ্নে বরাবর দ্বিধাবিভক্ত। আগে ছিল গুরুকুল। গুরুগৃহে বসবাস, শিক্ষাগ্রহণ ও জীবনবোধের সম‍্যক উপলব্ধি। এখন এই ধারা প্রায় বিলুপ্তির মুখে। কিন্তু শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তো চিরকালীন। কেউ কেউ বলেন গুরুহীন জীবন অভিভাবকহীন অনাথসম। আবার, কেউ কেউ বলেন গোটা পৃথিবীটাই যখন শিক্ষক তখন আর আলাদা ক’রে কোনো বিশেষ গুরু বা শিক্ষকের কী দরকার? নানা মুনির নানা মত থাকবেই। কিন্তু সংশয়ী কী করে?
নাস্তিকে ও আস্তিকে প্রবল তর্ক চলতে থাকে এবং সংশয়বাদী হাঁ ক’রে সেই তর্ক শোনে। উভয়েরই দ্বারা প্রভাবিত হয়, কিন্তু, স্থির ও দৃঢ় কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না। তবে হ‍্যাঁ, যখন প্রশ্ন ওঠে জীবনে শিক্ষকের প্রয়োজন আছে কি নেই তখন নাস্তিকেরাও নীরব থাকেন এবং নিমরাজি হয়েও চাঁদ সদাগরের মতো বাঁ হাতে ফুল ছোঁড়েন চ‍্যাং-মুড়ি-কানির উদ্দেশে।

মে মাসের এক সন্ধ্যা। প্রবল গরমে গলদঘর্ম হাঁসফাস সকলে। স্বনামধন্য এক সঙ্গীত শিক্ষকের গানের ঘরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে উদীয়মান এক শিষ‍্য গাইছে রবীন্দ্রগান : বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া…
শিক্ষক কাছেই কোথাও বেরিয়েছেন ঘরের কাজে। সমবেত অন‍্যান‍্য শিক্ষার্থীরা, যারা গানের ক্লাসে এসেছে তারাও শুনছে তাদের সতীর্থের গান। গানটি সামান্য দ্রুতলয়ে গাওয়া হচ্ছে।

গান শেষ হলে সকলেই তারিফ করছে গায়কের। এক নবীন ছাত্র তো গান শুনে এতটাই আপ্লুত যে সে বলছে এই অসাধারণ গায়কীর গুণে সে গানের মর্মার্থটিকে একেবারে ছবির মতো দেখতে পেয়েছে।
কিছুক্ষণ পরেই শিক্ষক বাড়ি ফিরলেন এবং ছাত্রদের মুখে সব শুনে ওই গানটিই গাইতে শুরু করলেন। সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনতে লাগলো গুরুর গান। গুরু গাইছেন ঈষৎ মধ‍্যলয়ে, দুলকি চালে, যেন বৈশাখের মৃদুমন্দ বাতাসের চঞ্চলতাহীন স্নিগ্ধ শান্ত গতিতে ভর ক’রে। গান শেষ হ’লে একটু আগেই তার সতীর্থের গানে আপ্লুত ছাত্রটি একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রুদ্ধ আবেগে গুরুর কাছে জানতে চাইলো তিনি গানটি এতো ধীর লয়ে গাওয়া সত্ত্বেও আগের গাওয়া গানের চেয়েও এতো ভালো লাগলো কেন! উত্তরে গুরু বললেন এই গানটির স্থায়ী অংশেই গানের লয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন গানের স্রষ্টা রবি ঠাকুর। বৈশাখের কোনো এক ভোরে এই গানটি গাইলে আরও বেশি করে বোঝা যাবে এই গানের লয়। ভোরের বাতাসের অচঞ্চল মৃদুমন্দ গতিই এ গানের মর্মার্থটিকে বয়ে নিয়ে যাবে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
গুরু বলছেন, শিষ‍্যেরা স্তব্ধ বিস্ময়ে শুনছে। গুরুর মুখে শোনা নির্দিষ্ট একটি গান ও সেই গানের অন্তর্নিহিত অর্থের ব‍্যাখ‍্যা, গানের সুর তাল ও লয়ের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম গূঢ়তত্ত্ব সারাজীবন মনে থেকে যায় দীক্ষিত শিষ‍্যশিষ‍্যাদের। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যেমন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিরামহীনভাবে সঞ্চারিত হতে থাকে গুরুমুখী তালিম।

ভারতীয় সমাজজীবনে হাজার হাজার বছর ধরে গুরু ও শিষ্যের নানা কাহিনি আজও পাঠ‍্যপুস্তকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু পাশ্চাত্যে? সেখানে কি গুরু নেই? শিষ‍্য নেই? শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী নেই?

মনে করা যাক সেই বিখ্যাত বিদেশী চলচ্চিত্র ‘ ব্লাড স্পোর্ট ‘। শত্রুশিবিরে ঢুকে প্রাণপন লড়াই চালাচ্ছে অসমসাহসী অভিযাত্রীদের ছোট্ট একটি দল। ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ। প্রাণঘাতী লড়াই। একটু অসতর্ক হলেই নির্ঘাত মৃত্যু। হাড়হিম করা শেষ লড়াই চলছে। একদিকে উন্নতশির, ন‍্যায় ও সততার প্রতিমূর্তি এক কান্তিময় যুবাপুরুষ। অপরপক্ষে ধূর্ত, অতিক্ষিপ্র,
দোর্দন্ডপ্রতাপ দানবসম এক খুনি, যে সোজাসুজি লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করতে না পেরে যুবাপুরুষের চোখে সম্ভবত বিষাক্ত কোনো পাউডার ছিটিয়ে তাকে সাময়িকভাবে অন্ধ ক’রে দিয়ে হিমশীতল দৃষ্টিতে বিপক্ষের অসহায়তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে।
সমাগত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তখন কী করলো সেই যুবা? কয়েক মুহূর্তের জন‍্য গুরুকে স্মরণ করলো। তার কৈশোরে একটি মাঠে গুরু তাকে তালিম দিচ্ছেন। চলছে ক‍্যারাটে প্রশিক্ষণ। শত্রুপক্ষ চোখে বিষাক্ত কিছু গুঁড়ো ছিটিয়ে সাময়িক অন্ধ করে দিলে সেই মুহুর্তে কীভাবে শুধুমাত্র শত্রুর পায়ের শব্দ শুনে ( ভাইব্রেশন ) তাকে মোক্ষম আঘাত হানতে হবে। ঠিক কতটা মনঃসংযোগ করলে, কতটা ধ‍্যানমগ্ন হলে, কতটা নিবিষ্ট শ্রোতা হয়ে উঠলে গ‍্যালারি- ভর্তি দর্শকদের চিৎকার ভেদ ক’রে প্রতিপক্ষের পায়ের শব্দ ও গতিবিধি সম‍্যক অনুধাবন করা যাবে। অর্থাৎ, এর মূলশিক্ষা হলো বিপরীত পরিস্থিতিতে কীভাবে চোখের বদলে কান দিয়ে দেখতে হবে। এই গুরুমুখী শিক্ষার সার্থক প্রয়োগেই শেষপর্যন্ত জয়ী হলো সেই যুবাপুরুষ।

গুরু ঋষি আয়োদধৌম‍্য ও শিষ‍্য আরুণি তথা উদ্দালকের গল্প কে না জানেন? শিষ‍্য সত‍্যকাম ( জাবাল) ও গুরু হারিদ্রুমতের উপাখ‍্যানও সকলেরই জানা।

এবার একটু স্মরণ করা যাক প্রমথ চৌধুরীর লেখা ‘ মন্ত্রশক্তি ‘ নামক বিখ্যাত গল্পের আশ্চর্য চরিত্র ঈশ্বর পাটনীকে। লম্বা ছিপছিপে বেতের মতো চেহারার এই প্রৌঢ় ছোকরা বয়সে লাঠি খেলতেন। গুরুর কাছে শিক্ষা পেয়েছিলেন লাঠিখেলার সময় হাত বা লাঠির দিকে নয় , তাকাতে হবে প্রতিপক্ষের চোখের দিকে। সেইভাবেই তিনি তাঁর সময়ে অপরাজেয় লেঠেল হয়ে ওঠেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কোনো একটি ঘটনায় তাঁর প্রাণসংশয় হওয়ায় তিনি দেবতার মন্দিরে কসম খেয়ে লাঠিখেলা ছেড়ে দেন। কিন্তু তার কুড়ি পঁচিশ বছর পরে বিখ্যাত সব লেঠেলদের জমায়েতে এক লাঠিখেলার আসরে তাঁর সম্মানীয় একজন নায়েব মশাইয়ের একান্ত অনুরোধে বহুকাল পরে হাতে লাঠি তুলে নেন এবং সবাইকে পরাস্ত ক’রে নায়েব মশাই ও উপস্থিত সকলকে চমৎকৃত ও বাকরুদ্ধ ক’রে দেন। লড়াই শেষে পাকা লেঠেল অথচ গুলিখোর মিছুর কথা বলতে গিয়ে ঈশ্বর নায়েব মশাইকে বলেন সেই অবিস্মরণীয় কথা, ‘ হুজুর, নেশায় শরীরের শক্তি যায়, কিন্তু গুরুর কাছে শেখা বিদ‍্যে তো যায় না। বিদ‍্যে হচ্ছে আসল শক্তি। ‘

যাঁরাই প্রকৃত গুরুসঙ্গ করেছেন তাঁরা তাঁদের যে কোনো সঙ্কটে চোখ বুজে গুরুকে স্মরণ করেন।
কাকভোরে, গভীর রাতে অথবা কনে দেখা আলো অন্তর্হিত হওয়ার প্রাক্কালে অবগুন্ঠনবতী মুখ-আঁধারি সন্ধ্যার আবছা আলোয় তাঁরা দেখতে পান প্রাণতপস‍্যায় সিদ্ধ এক জ‍্যোতির্ময় পুরুষ স্মিতহাস‍্যে তাঁদের সঙ্কটমুক্তির গান শেখাচ্ছেন আশ্চর্যরূপে দীপ্ত এক মাঙ্গলিক সুরে। আর সেই মৃত্যুঞ্জয় সুর আকাশ বাতাস ও বিস্তীর্ণ চরাচর অতিক্রম ক’রে ছড়িয়ে পড়ছে দূরে আরও দূরে সম্পূর্ণ অজানা এক অন্তহীনতায়।

আরও পড়ুন- কাশ্মীর জ্বলছে, কেন্দ্রের নেতারা সিনেমার প্রচার চালাচ্ছেন: তোপ সঞ্জয় রাউতের

 

 

Previous articleNose bleed fever: দেশে নতুন উপসর্গ ‘নোজ ব্লিড ফিভার’, গুজরাটে মৃত্যু
Next articleShahbaz Sharif : যে কোনও সময় গ্রেফতার হতে পারেন পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ