‘হেমন্ত মিত্রের জবানবন্দি’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ আমি সাতে নেই, পাঁচেও নেই। সাথে নেই, পাশেও নেই। নয়ে নেই, ছয়েও নেই। তা বলে আমি কোথাও নেই তা তো নয়। বহাল তবিয়তেই আছি। তবে হ‍্যাঁ, এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমার গোড়ায় গলদ। গরমে গলদঘর্ম, শীতে হাড়কাঁপুনি আর বর্ষায় বজ্রবিদ‍্যুতে আমি নাজেহাল। হেমন্ত আর বসন্ত কখন আসে কখন যায় বুঝতেই পারি না। শুধু শরৎ এলেই আমার মন বিদ্রোহ করতে চায়। আবার শরতেই আমি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো সামাজিক হয়ে উঠি। অন‍্য ঋতুগুলোয় প্রায় চোখ বুজে থাকি। পৃথিবীর পাড়ায় পাড়ায় ঘটনা ঘটতেই থাকে নিরন্তর।কিন্তু আমি কিছু দেখতেও চাই না, বুঝতেও চাই না আর ভাবতেও চাই না। লোকে কত কথা বলে, কত কিছু নিয়ে আলোচনা করে। উত্তেজিত তর্কাতর্কি চলতে থাকে। চায়ের কাপে কত তুফান ওঠে। ওসব আমার গায়ে লাগে না। কারণ সন্তর্পনে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কৌশল আমি জানি।
শুধুমাত্র শরতে আমি মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের মতো মানবিক হয়ে উঠি। তখন অনেক কিছু চোখে পড়ে। তখন আমার চোখ খুলে যায়।

আমি দেখতে পাই পথের ধারে শ্বেতশুভ্র রাশি রাশি কাশ ফুল । শিউলি ফুলের গন্ধে আকুল আদিগন্ত চরাচর। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ আমার অন্তরকে আশ্চর্য এক উদ্দীপনায় প্লাবিত করে। সহসা যেন সাহসী হয়ে উঠি। কিসের সঙ্কোচ? কীসের ভয়?

আরও পড়ুন- কবে যে কোথায়, উৎপল সিনহার কলম

প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও লোকজন নিয়ে বরাভয়দাত্রী মা আসছেন মর্ত‍্যে, সাহসী হয়ে ওঠার এই তো সময়। এমনিতে নিজের দেশের নিন্দা আমার সহ‍্য হয় না। অলিম্পিক বা এশিয়ান গেমস্-এ ভারতীয় খেলোয়াড়েরা সোনা-রূপার পদক পেলে ভালোই লাগে। ক্রিকেট বা হকিতে অন‍্য দেশের কাছে ভারত হেরে গেলে আমার মন খারাপ হয়। কিন্তু শরতকাল এলেই আমার সব ওলোটপালট হয়ে যায়। আমার চোখ ফোটে। দেবীপক্ষে নিরপেক্ষ থাকতে পারি না কিছুতেই। তখন মনে হয় একজনের হাতে কোটি কোটি টাকা আর অন‍্যজনের পকেট গড়ের মাঠ! এই ভয়ঙ্কর অশ্লীলতা আমরা দীর্ঘ ছিয়াত্তর বছর ধরে মুখ বুজে সহ‍্য করে চলেছি কী করে? তাও কিনা ‘ এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে ‘!

একদিকে সম্পদের পাহাড়, অন‍্যদিকে অনাহার! এটা অশ্লীলতা নয়? এটা কোনো দেশ? এটা কোনো ব‍্যবস্থা? এটা কোনো সভ‍্য সমাজ?

অশ্লীলতা কি শুধুমাত্র পোশাকে আর আচরণে? বিপুল বৈভবের বহুতল আবাসনের নীচেই ফুটপাতে ভাঙা বাঁশ আর ছেঁড়া পলিথিনে মোড়া সারি সারি নরকবাস অশ্লীল নয়? পুজোয় হাজার হাজার গরীব কচিকাঁচাদের নতুন পোশাক হবে না অথচ সরকারি কর্মচারীদের কাঁড়ি কাঁড়ি বোনাস অশ্লীল নয়?

এই চরম অশ্লীল দেশে ৭৬ বছর ধরে তেলা মাথায় তেল দেওয়া ছাড়া সরকারের আর কোনো কাজ নেই। একদিকে আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের স্নিগ্ধ সরোবর, অন‍্যদিকে চিরদারিদ্রের বিষাদসিন্ধু।

পার্লামেন্টের দুই কক্ষে চূড়ান্ত সুবিধাপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও সাংসদেরা মাত্র তিন মিনিটে টেবিল চাপড়ে ধ্বনিভোটে নিজেরাই নিজেদের মাইনে হাজার হাজার টাকা বাড়িয়ে নেয় নির্লজ্জ বিলাসিতায় অথচ শ্রমিক-কৃষকদের একশো টাকা ভাতা বাড়াতে বছরের পর বছর মিটিংয়ের পর মিটিং করতে থাকে। এটা অশ্লীল নয়? এটা একটা দেশ? কারোর কোনো লজ্জা নেই?
অশ্লীল দেশের অশ্লীল সরকার আর কতদিন?

ও হ‍্যাঁ, কথায় কথায় একটা জরুরি কথা তো বলতেই ভুলে গেছি। শরৎ ফুরোনোর সঙ্গে তাল রেখে আমার সাহসও কিন্তু ফুরোতে থাকে। চোখের আলো নিভে আসে। তখন কানে তুলো পিঠে কুলো। সামাজিকতা ও মানবিকতা চুপচাপ আলমারিতে তুলে রাখি। তখন অন‍্যমনস্কতাই আমার একমাত্র সঙ্গী। মা কৈলাসে ফিরে যান। কেমন যেন অসহায় লাগে। সারাটা ক্ষণ বিমর্ষ মন। কেমন যেন কিংকর্তব‍্যবিমূঢ় অবস্থা! অদূরেই হেমন্তের হাতছানি। মনে পড়ে যায় ‘ হেমন্তে হিম লেগে গোবিন্দ গালফোলা ‘। এই সুযোগে আমিও আর দেরি না ক’রে গাল ফুলিয়ে আগাম গাইতে থাকি :
এই হেমন্তে কাটা হবে ধান… ‘

আরও পড়ুন- আজ মহা সপ্তমী, উৎপল সিনহার কলম

 

Previous articleদুর্গাপুজোর কার্নিভালের বিশ্বায়ন, ঐতিহ্য-শিল্প-সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যে বিস্মিত বিদেশীরাও
Next articleBreakfast news: ব্রেকফাস্ট নিউজ