বঙ্গবিজয় এক অলীক স্বপ্ন

সঞ্জয় সোম

গত পরশুদিন আমি লিখেছিলাম যে বিজেপি মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানা দুটো রাজ্যেই হয়তো ৩/৪ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। একথা বলার ভিত্তি কি ছিল? রাজ্য থেকে দফায় দফায় ধেয়ে আসা ওখানকার দলীয় কর্মীদের অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক আশ্বাসবাণী। আর বাস্তবে ফলাফল যে দিকে এগোচ্ছে তাতে একটা জিনিষ একেবারে স্পষ্ট: দুটি রাজ্যেই বিজেপির তৃণমূলস্তরের কর্মীরা সাধারণ মানুষের পাল্স বুঝতে পারেননি এবং মাত্র একটা টার্ম সরকারে থেকে এইধরণের জনসংযোগের তার কেটে যাওয়ার প্রভাব অবশ্যই সুদূরপ্রসারী।

মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানা দুজায়গাতেই রাজ্য এবং কেন্দ্রে একই দল ক্ষমতায় ছিল, সুতরাং বঞ্চনার ফলে উন্নয়ন ঠিক মতো হয়নি, এ গল্প এক্ষেত্রে খাটে না। মহারাষ্ট্রে তবু শিবসেনার জন্য সরকারটা হয়তো টিকে গেল, হরিয়ানায় যেহেতু বিজেপি একা, তাই অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। মনে হয় আগামী বিধানসভার নির্বাচনে ঠিক এই একই ধরণের ফলই হতে চলেছে ত্রিপুরা এবং আসামে, কারণ ও দুটি রাজ্যেও দল মানুষের আশাপূরণে ব্যর্থ।

পশ্চিমবঙ্গের দশা কি হবে তা আগামী বছরের কোলকাতা কর্পোরেশনের প্রস্তুতির বহর দেখেই বোঝা যাচ্ছে, গোটা দলের একদম কোনো হেলদোল নেই। ওদিকে তৃণমূল কিন্তু এখন থেকেই কোমর কষে নেমে পড়েছে এবং আমার ধারণা তারা এবারেও যথেষ্ট ভালো ফল করবে। আবার অন্যদিকে দেখুন, যখন সিপিএম আর তৃণমূল ক্রমাগত স্ট্রিট কর্নার মিটিং করে করে মানুষের মনে নাগরিকপঞ্জি সম্পর্কে কিছু ধারণা গেঁথে দিচ্ছে, বঙ্গবিজেপি কোথায় সক্রিয়ভাবে তার রাজনৈতিক মোকাবিলা করবে, তা না, গোটা দল এখন গান্ধি সংকল্প যাত্রা করতেই ব্যস্ত! ইনি কোন গান্ধী? সেই তিনি, দেশভাগের মার যাদের সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হয়েছিল, সেই বেশিরভাগ বাঙালিই যাঁকে মোটেও পছন্দ করেন না।

এই যে one formula fits all-এর ব্যামো, এটাই বিজেপিকে নিয়ে ডুববে। আবার বলছি এবং পরিষ্কার করে খোলাখুলি বলছি: বাংলার বিজেপি বাঙালিকে taken for granted ধরে নিয়ে এগোচ্ছে, অথচ বাঙালির বৈশিষ্ট্য, তার sentiment বুঝছে না। বাংলার মানুষ অপশাসন থেকে পরিত্রাণ চাইছেন এটা ঠিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যাদের থেকে পরিত্রাণ চাইছেন তাদেরই আপনারা জামা বদল করিয়ে নিয়ে এসে ধোয়া তুলসীপাতা বলে পেশ করে দেবেন আর মানুষ তা মুখ বুঝে মেনে নেবেন, মানুষকে এতটা বোকা ভেবে নেওয়া সবচেয়ে বড় বোকামি।

বিজেপির আরো একটা সাড়ে সর্বনাশ হচ্ছে, তা হলো প্রবুদ্ধজনদের হেয় করা। সারা দেশ যাঁদের মাথায় তুলে নিচ্ছেন, বাঙালি নেতৃত্ব তাঁদেরই ব্যাপারে সর্বসমক্ষে কুকথা বলছেন, এ বড় অদ্ভুত ব্যাধি। এতে একমাত্র বঙ্গবিজেপির মানসিক দৈন্যতাই প্রকাশ পাচ্ছে, এবং সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি, যারা ধীরে ধীরে দ্বিধা কাটিয়ে কাছাকাছি আসছিলেন, তাঁরা আবার দূরে সরে যাচ্ছেন। হরিয়ানায় বিজেপি জাটদের দল হয়ে উঠতে পারেনি, তাই আশাহত হয়েছে। মহারাষ্ট্রতে শিবসেনা তার মারাঠি identityতে অবিচল থাকার ফলে খানিকটা মুখরক্ষে হয়েছে, নাহলে ওখানেও ব্যাথা ছিল।

অদ্ভুতভাবে, পূর্বক্ষেত্রের বিজেপিকে দেখলে মনে হয় যেন রাজ্যপরিচালনার জন্য এ তল্লাটে কোনো ভালো লোক নেই। ত্রিপুরার বিজেপি নেতা বোধহয় civil servent আর civil engineerএর পার্থক্যই বোঝেন না, সুতরাং ওখানকার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। সুশাসনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে আসামে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি আজ ওখানে আর কারোরই প্রতিনিধি নয় – অহমিয়াদের নয় কারণ বাঙালি খেদাতে পারেনি, হিন্দু বাঙালিদের নয় কারণ তাদের রক্ষা করতে পারেনি, ১১ লক্ষ আজ নাগরিকপঞ্জির বাইরে, কার্বিদের নয় কারণ তারাও ২ লক্ষ নাগরিকপঞ্জির বাইরে, আর মুস্লিমরা তো কোনোকালেই বিজেপির সমর্থক ছিলেননা; তাহলে বাকি রইলোটা কে, যারা পরেরবার বিজেপিকে ভোট দেবেন?

পশ্চিমবঙ্গে মাঝেমাঝেই শুনি ২০২১শে নাকি বিজেপি ক্ষমতায় আসছেই। বিধানসভার ভোট আর লোকসভার ভোট এক নয়, মোদি-শাহ জুটিকে দেখিয়ে বিধানসভা জেতা যাবেনা। ওদিকে শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি মানুষের একটা বিশ্বাস কিন্তু আজও কাজ করে, ওনার দল যেমনই হোক না কেন, ভদ্রমহিলা কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সৎ। সুতরাং এই সারদা, নারদা, রোজ ভ্যালি ইত্যাদিতে যদি ওনার গোটা দলটাও জেলে চলে যায়, উনি একাই বিধানসভা নির্বাচন টেনে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ইতিমধ্যেই সিবিআইয়ের কখনো নরম কখনো গরম মনোভাবের জন্য মানুষের মনে সন্দেহ প্রবল। তার ওপর আবার বঙ্গবিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাবকে ছোট করে দেখছে, সেটা যে কত বড় ভুল তা দল পরে অক্ষরে অক্ষরে টের পাবে। বিজেপিতে প্রত্যহ যে মুখগুলো দেখতে পাই, তাঁদের একজনও এখনো পর্য্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশমার ধারে কাছে আসার জায়গায় নেই।

আগামীদিনে হয়তো অনেককিছুই পাল্টে যাবে, হয়তো বিজেপি দলীয় সংগঠনের খোলনালছে বদলে একদম আনকোড়া নতুন ভালো ভালো সৎ শিক্ষিত মুখ সামনে নিয়ে আসবে অথবা হয়তো একেবারে শেষবেলায় আস্তিন থেকে তাদের তুরুপের তাস বের করবে, কি যে করবে তার ভবিষ্যৎবাণী করা খুব মুস্কিল। কিন্তু একটা কথা নিশ্চিত করে এখনই বলতে পারি। এই মুহূর্তে সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির যা সাংগঠনিক অবস্থা, তাতে ২০২১শে তাদের রাজ্যে ক্ষমতায় আসা এক অলীক কল্পনা বই আর কিছু নয়।

আরও পড়ুন-Breaking: বিজেপির বিজয়া সম্মিলনীতে সৌরভের বৌদি

 

Previous articleবিজেপির একমাত্র পুঁজি “ধর্ম” এবার কাজে আসেনি, দাবি সোমেনের
Next articleমহারাষ্ট্রে ম্যাজিক ফিগার ছুঁয়েও চিন্তায় গেরুয়া শিবির