এতক্ষণে সেই আড্ডা হয়তো শুরু হয়ে গিয়েছে, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

কৈশোরে প্রেমে পড়েই প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নিজেই বলেছেন, “আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ! সেই আমিকে প্রকাশ করতে গিয়েই কবিতা। অভিনয়ে নিজেকে আড়াল করাটাই অভিনেতার কাজ। যারা নিজেকে দেখায় তারা অভিনেতা নয়। শো-ম্যান হতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে বেরিয়ে আসে আমার সেই আমি, যে নিজেকে আড়াল থেকে টেনে এনে প্রকাশ করতে চায়। সেই আমি মুক্ত। কবিতা আমাকে মুক্ত করে দেয়”।

অবলীলায় স্বীকার করেছেন, স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়কে একসময় চিঠির বদলে কবিতা দিতেন সৌমিত্র। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “কখনও কখনও চিঠির ফর্মে না দিয়ে ওর প্রতি আমার অনুভূতিগুলো কবিতার আকারে পড়ে শুনিয়েছি। দীপা বরাবরই আমার কবিতার বড় শ্রোতা।”

দুরন্ত রোমান্টিকতা৷ কিন্তু হঠাৎ কবিতা লেখার কথা ভাবলেন কেন ?
২০১৪ সালে ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা’ বইটি প্রকাশের দিন কবি এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন, “হঠাৎ কেন? আমি তো অনেকদিন ধরেই কবিতা লিখছি। আত্মীয়- পরিজনদের জন্মদিনেও আমি উপহার হিসাবে দিয়ে থাকি নতুন লেখা একটা করে কবিতা”। কবি সৌমিত্র-র প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিলো আজ থেকে ৪৫ বছর আগে, ১৯৭৫-সালে৷ প্রথম কবিতার বইয়ের নাম, ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’। ৫৪টি কবিতার সেই সংকলন প্রকাশ করেছিল অন্নপূর্ণা পাবলিশিং হাউস। ওই বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী আর কেউ নন, স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
তবে কবি-খ্যাতি তিনি বোধহয় সেভাবে চাননি৷ আবৃত্তিকার হিসেবে ডাকসাইটে সৌমিত্র ভারি লজ্জা পেতেন নিজের কবিতা পাঠ করতে৷ অভিনেতা হিসেবে যখন তিনি মধ্যাহ্নের সূর্য, তখনও কবি হিসেবে
তিনি বিরাজ করতে ভালোবাসতেন জীর্ন কোনও কুটিরের সাঁঝবাতি হয়ে, একাকী, নীরবে, সঙ্গোপনে।
এই নিয়ে মজাও সে সময় কম হয়নি৷ আস্ত একটা ছড়াই তখন লিখে ফেলেছিলেন অমিতাভ চৌধুরি,
“নুন-সাহেবের ছেলে তিনি সত্যজিতের নায়ক,
অভিনয়ে ছাড়েন তিনি
ফাস্টোকেলাস শায়ক।
কখন তিনি অপুবাবু,
কখন তিনি ফেলুদা,
মাঝে মাঝে পদ্য লেখেন,
যেন পাবলো নেরুদা।’

প্রথম কবিতার বই, ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’, তারপর একের পর এক, ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা, শব্দেরা আমার বাগানে, পড়ে আছে চন্দনের চিতা, হায় চিরজল, পদ্মবীজের মালা, হে সায়ংকাল, জন্ম যায় জন্ম যাবে, হলুদ রোদ্দুর, মধ্যরাতের সংকেত। মোট ১৪টি কাব্যগ্রন্থ, তবুও কবিতার দুনিয়ায় কবি সৌমিত্র-র হাজিরা একেবারেই অনিয়মিত৷ অনিয়মিত হলেও তিনি কিন্তু ছিলেন, হারিয়ে যাননি৷ কেন অনিয়মিত, তার ব্যাখ্যায় এক সাক্ষাতকারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনেকদিন আগে বলেছিলেন, “আমি কবিতা লেখার কে? কবিতা আমার দ্বারা লিখিত হয়। যারা নিয়মিত কবিতা লেখেন, তারা কবিতা সম্পর্কে অনেক বেশি মনোযোগী। আমি পাঁচ কাজের লোক। তবে অভিনয় ছাড়া যে কাজটা প্রায় কৈশোর থেকে করে আসছি সেটা কবিতা লেখাই। কখনও শ্যুটিংয়ে দুটো শটের মাঝখানেও কবিতা লিখে ফেলি। বাড়িতে এসে রাত্রে মেজে ঘষে ঠিক করি। অনেক সময় এমন হয় সারাদিন মাথায় নানা কাজের ফাঁকে একটা দু’টো লাইন ঘুরঘুর করছে। বাড়ি ফিরে রাতে যখন বসলাম সেই লাইন থেকেই কবিতা জন্ম নেয়। আবার কখনও কোনও ইমেজ বা চিত্রকল্প মনে আসে। রাতে সেই চিত্রকল্পই হয়ে ওঠে কবিতার ভাষা। এক লহমায় খসখস করে একটা গোটা কবিতা লিখে ফেলি কখনও। কখনও বা একটা কবিতাই দু’চারদিন ধরে কাটাকুটি সংশোধন করে তৈরি হয়। বিভিন্ন সময় কবিতার যে মূল ভাবনাগুলো আছে সেগুলোকে রক্ষার চেষ্টা করি। তার জন্য একটা লাল খাতা আছে আমার। তাতে টুকে নিই। বাকিটা রাত্রে। এত কিছু করতে সময় তো একটু বেশিই লাগে”৷ ‘মধ্যরাতের সংকেত’-এর ভূমিকায় কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “আমি কবিতার চলতে শুরু করার সাক্ষী,
আমি দেখতে পেয়েছিলাম
চলতে চলতে সে এই শহর ছাড়িয়ে যাচ্ছে,
প্রথম মেঘ যেমন ক’রে আকাশ ঢেকে ফেলতে থাকে
প্রথম প্রেম যেমন…”৷ এমন অনুভবে ঋদ্ধ হয়েই একসময় তিনি কবিতার জগতের গর্বিত এক বাসিন্দাই হয়ে গিয়েছিলেন৷

অভিনেতা ও পরিচালক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কাজের ফাঁকে সময় পেলেই ছবি আঁকতেন, কবিতা লিখতেন৷ তো, এই কবি পরিচয় কেমন লাগে ? তাঁর এক বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এ প্রশ্নের উত্তরে সৌমিত্র বহুদিন আগে বলেছিলেন,”বেশ ভালোই লাগে। এখানে শঙ্খ ঘোষের মতো জ্ঞানীগুণী-পণ্ডিত মানুষ আছেন। তিনি বড় কবি, সমালোচকও। আছেন আমার বাল্যবন্ধু সুধীর চক্রবর্তী। তিনিও বিদগ্ধজন। পরবর্তীকালে কবি হিসেবে যদি কেউ আমাকে বিচার করতে চান, তাহলে তার একটা সামগ্রিক চিত্র আমার বইয়ে ধরা থাকবে। হয়তো কিছু পাঠকও আছে।”

কবিতা সমগ্রের ভূমিকাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম কৈশোরের নতুন জন্মানো প্রেমাকাঙ্ক্ষার আন্দোলনে৷ পরবর্তীকালে অবশ্য একটু একটু করে প্রকৃতি, সমাজ, বেঁচে থাকার অপরিহার্য অভিজ্ঞতাও কবিতার মধ্যে ফুটে উঠতে আরম্ভ হলো। কোনও বড় ভাব বা আদর্শের প্রভাবে আমার লেখা শুরু হয়নি।”

তিনি নিজেই বলেছেন, “আমাকে কবিতা লেখায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শক্তির জন্যই তো আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’ প্রকাশিত হয়। অনেকদিন ধরেই ও বলছিল ‘পুলুবাবু একটা কবিতার বই বের করো।’ কিন্তু আমার মনে হতো তখনও সময় আসেনি। এই করতে করতে চল্লিশ বছর বয়সে শক্তি উঠে পড়ে লাগল। এক প্রকাশক ওর কাছে গিয়েছিলেন আমার কবিতাগুলো বই আকারে প্রকাশ করবে বলে। শক্তি তখন আমায় বললো, ‘দ্যাখ পুলু, প্রকাশক নিজে এসেছে। আমরা চেষ্টাচরিত্র করে যোগাড় করিনি যখন এবার বই বের হওয়া উচিত।’ শক্তি মাঝে মাঝে আমার কবিতা পড়ে বলত, ‘এই কবিতাটা একটু রবীন্দ্রনাথের মতো হয়েছে।’ সেই শুনে ওই কবিতা আমি বাতিল করে দিতাম। আসলে তখন আমাদের দুরন্তভাবে প্রভাবিত করছে জীবনানন্দ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরা। লেখায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকুক আমরা চাইতাম না। ওই প্রভাবটা থাকুক জীবনে।”

কবিবন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারা যাওয়ার সময় কেঁদে ফেলেছিলেন সৌমিত্র৷ বলেছিলেন, “সুনীলের সঙ্গে শেষের দিকে অনেকগুলো বছর সামাজিক ভাবে দেখাশোনার পথ খুব প্রশস্ত ছিল। প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যায়। শক্তিও খুব বন্ধু ছিল। কিন্তু এক বিশেষ কারনে শক্তির সঙ্গে তো আর যখনতখন সামাজিক ভাবে দেখাসাক্ষাতের সুযোগ হওয়া সম্ভব ছিল না”৷

ধরে নেওয়াই যায়, এখানে ঠিক যে বিন্দুতে দু-দু’বার আড্ডা থমকে গিয়েছিলো, দীর্ঘ বিরতির পর ঠিক সেখান থেকেই তিনবন্ধুর আড্ডা এতক্ষণে নতুনভাবে জমে উঠেছে৷

কবিরা এমনই হন৷

 

 

Previous articleভ্যাকসিন ট্রায়ালের পর কেমন শারীরিক অবস্থা? জানালেন স্বেচ্ছাসেবকরা
Next articleনির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কর্তৃত্ব নয়, দিল্লির প্রস্তাব খারিজ নবান্নের