‘রবির আলোয় হেলেন’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

মেয়েটির তিন-তিনটি ইন্দ্রিয় বিকল , রুদ্ধ । তবু তার বুকে জেগে থাকে এক অপরূপ আশা , দেখা হবে , দেখা হবে , তাঁর সাথে একদিন ঠিক দেখা হবে ।

এই আশায় , এই আনন্দে তার কোমল দেহকক্ষের একাধিক রুদ্ধদ্বারের কথা প্রায়ই ভুলে যায় সে ।‌ তার স্থির বিশ্বাস , একদিন এক অবিনশ্বর আলো এসে দাঁড়াবে তার মুখোমুখি , উদ্ভাসিত হবে তার জীবন , ধন্য হবে মানবজীবন।

 

মাত্র ১৯ মাস বয়সে এক কঠিন অসুখে তাঁর শরীরে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় । তাঁর দু’চোখের দৃষ্টি চলে যায় । একইসঙ্গে তিনি মূক ও বধির হয়ে পড়েন । তাঁর ছ’বছর বয়সে তাঁর বাবা ও মা তাঁকে নিয়ে যান প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী তথা টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল-এর কাছে । তিনি প্রাথমিকভাবে নিরীক্ষণ করে রায় দেন যে , মেয়েটি চোখে দেখতে পাবে না , কানেও শুনতে পাবে না , তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হলে হেলেন স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি একটি সুন্দর জীবন পেতে পারে , কারণ সে খুবই মেধাবী ‌।
তারপর ব্রেইল পদ্ধতিতে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় এনি সুলিভান নামে একজন গৃহশিক্ষিকার কাছে । ইনি নিজেও একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন । হেলেনের জীবনে এই শিক্ষিকার অবদান অপরিসীম । ১০ বছর বয়সে নরওয়েতে উদ্ভাবিত এক পদ্ধতি অনুসরণ করে কথা বলা শেখেন হেলেন কেলার ।

দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন পড়াশোনায় । ১৯০৪ সালে হেলেন প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন । তার আগেই তাঁর আত্মজীবনী ‘ দ্য স্টোরি অফ মাই লাইফ ‘ প্রকাশিত হয় ।

সমাজের বাক , শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সারা জীবন কাজ করে গেছেন হেলেন কেলার । তিনি আমেরিকান মেয়ে । তাঁর জীবদ্দশায় যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রেসিডেন্ট ছাড়াও মার্ক টোয়েন , চার্লি চ্যাপলিন প্রমুখ বিখ্যাত মানুষদের সহায়তা পান তাঁর কাজে । ১৯১৫ সালে ‘ হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ‘ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন বিশেষ রূপে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য , যা এখনও নিরন্তর কাজ করে চলেছে । বাক , শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং গণমানুষের সহায়তা অর্জনে নিবেদিত প্রাণ হেলেন কেলার সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন আরও একটি কারণে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত , পঙ্গু ও বিকলাঙ্গদের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন নির্ভয়ে সেবা ও শুশ্রূষার দায়িত্ব নিয়ে এবং তাঁদের জুগিয়েছেন ভরসা ও আশ্বাস। নিজের শারীরিক অসহায়তা তুচ্ছ করে বারবার দাঁড়িয়েছেন দুর্গত ও বিপন্নদের পাশে । নিজের শরীর ও মন জুড়ে নেমে আসা অতল অন্ধকার সরিয়ে বারবার আলোকিত করেছেন নিজেকে এবং তাঁর সামাজিক পরিপার্শ্বকে ।

আমার দু’চোখ থেকে তারা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো , যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল , কিন্তু আমি স্মরণে রেখেছি মিল্টনের হারানো স্বর্গ ।

আমার শ্রবণশক্তি তারা কেড়ে নিলো , যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল , বিটোফেন এসে মুছিয়ে দিলো আমার অশ্রু।

আমার জিভ অসাড় করে দিলো তারা , যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল। ছোট থেকেই আমার ঈশ্বরের সাথে কথা হয়, অফুরান কথা। আমার আত্মাকে সরানোর অনুমতি তিনি কাউকে দেবেন না ।
( হেলেন কেলার , ২৭ জুন , ১৮৮০ — ১ জুন , ১৯৬৮ )

অপরাজিতা এই মেয়ে । এরই সম্মুখে একদিন এসে দাঁড়াবেন কান্তিময় আলোর এক দিশারী । ‘ অন্ধকারের উৎস হতে ‘ এসে যিনি অন্যতম পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবেন হেলেন কেলারের । হেলেনের জীবন যেন এক রূপকথা । মহামান্য মার্ক টোয়েনের মতে হেলেন কেলার উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ । ব্রেইল হরফে রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন হেলেন । তখন থেকেই তাঁর একান্ত ইচ্ছা কবিকে দেখার , তাঁর সঙ্গে কথা বলার । তারপর একদিন এলো সেই বহুকাঙ্খিত দিনটি । অসামান্য কিছু মুহূর্ত । ‘ মিড স্ট্রিম মাই লেইটার লাইফ ‘ বইয়ের একটি অধ্যায়ে হেলেন লিখে গেছেন তাঁর জীবনের সেই মহা মূল্যবান দিনটির কথা ।

রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে । বড়ো পৃথিবীর প্রাণের জোয়ার শান্তিনিকেতনের প্রাণধারার সঙ্গে মেলানোর জন্য । এখানে একটি কমিউনিটি হল-এ ‘ The meeting of East and West ‘ প্রবন্ধটি পাঠ করেন রবীন্দ্রনাথ । প্রবন্ধটির বক্তব্যে মুগ্ধ হন হেলেন কেলার । হেলেন পড়েছিলেন ‘ গীতাঞ্জলি ‘ ও ‘ গার্ডেনার ‘ ।

রবীন্দ্রনাথও উৎসাহী ছিলেন হেলেনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে। কবির কাছে এসে উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন হেলেন । কবির মুখ , ঠোঁট ও কণ্ঠ স্পর্শ‌ করে হেলেন যেন ছুঁতে চাইলেন এক মহামানবের হৃদয়কে । এরপর যেন সত্য ও সুন্দরের উপাসনার মাঝেই প্রাণের আরাম ও আত্মার শান্তি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন তিনি । আলো বিনিময়ের সূত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গভীর বন্ধুত্ব মরণসাগরপারে অমর হয়ে রইলো ।

আরও পড়ুন- আচমকাই উড়ে এল ইট! প্রচারে বেরিয়ে আহত জগন, চিকিৎসা সেরেই ‘কামব্যাক’

বিপুল সুদূরের আহ্বান শুনেছিলেন দুজনেই । এই আন্তরিকতাই মিলিয়ে দিলো দুই কৃতীকে । রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করেই বাকি জীবন কাটালেন হেলেন কেলার । লিখে গেলেন , ‘ প্রত্যেক মানুষেরই মনের অতলে রয়ে গেছে সবুজ মাটি আর টলটলে জলের স্মৃতি । অন্ধত্ব বা বধিরতা আমাদের পূর্বপুরুষদের দেওয়া এ অধিকার লুট করে নিতে পারে না । উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এ ক্ষমতা অনেকটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মতো — আত্মার ইন্দ্রিয় , যা একইসঙ্গে দেখে , শোনে এবং অনুভব করে ‘ ।

 

 

Previous articleআচমকাই উড়ে এল ইট! প্রচারে বেরিয়ে আহত জগন, চিকিৎসা সেরেই ‘কামব্যাক’
Next article‘ফ্যাসিস্ট রাজের বিরোধিতায় ‘No Vote To BJP’ স্লোগান ‘দেশ বাঁচাও’ গণমঞ্চের