মন কি বাত : এবার পোষ্য হোক দেশীয়

চন্দ্রিমা নাগ : নরেন্দ্র মোদি এবার একেবারে হইচই ফেলে দিয়েছেন। প্রতিবারই ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানের পর একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সেদিক থেকে এবার যেটা হচ্ছে, সেটা নতুন কিছু নয়। তবে, বিষয়গতভাবে বিচার করলে এ একেবারে নিউ নর্মাল আবহে নতুনতম বিষয়।

স্বদেশী যুগের স্লোগানের মতো মোদিজি আওয়াজ তুলেছেন, এবার থেকে পোষ্য হোক দেশি।
কথাটা শোনা ইস্তক পাড়ায় পাড়ায় শোনা যাচ্ছে একটাই কথা, এবার ল্যাব্রেডর, জার্মান শেফার্ড, হাস্কি, শিদজু, এসবের দিন শেষ। নেড়ির দিন শুরু।

এই যে দেশি কুকুরকে নেড়ি বলা, এটা কিন্তু যারপরনাই আপত্তির কারণ হতে পারে। আসলে আমরা অনেকেই জানি না, এখন যদি মোদিজির আহ্বানের পর জেনে উঠতে পারি তবে মঙ্গল, যে, দেশীয় কুকুরেরও বর্ণ নাম রয়েছে। ‘মন কী বাত’ –এ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উল্লিখিত যেসব দেশি কুকুরের প্রজাতির কথা আমরা শুনেছি, যেমন: কোম্বাই, ছিপ্পিপারাই, রাজা পালায়াম, মুধল হাউন্ড ইত্যাদি, সেগুলোর বেশিরভাগই শিকারি কুকুর হিসেবে বেশি সমাদৃত।

দক্ষিণ ভারত এদের উৎস ভূমি। এর বাইরে, উত্তর ভারতের যে কুকুরগুলো তীক্ষ্ণ ঘ্রাণ শক্তি, প্রবল কর্ম ক্ষমতা এবং তাড়া করার ব্যাপারে প্রশ্নাতীত দক্ষতার অধিকারী, সেগুলো এসেছে মূলত মধ্য প্রাচ্য, বিশেষত আফগানিস্তান থেকে। এদের দৈহিক গঠনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, বুকটা বেশ ঢোকা মতো আর লম্বা লম্বা পা। এ ছাড়াও আছে হিমালয় অঞ্চলের শীপ ডগ আর ভুটিয়া কুকুর।

আরও পড়ুন : ভারতের বন্ধুত্বের জবাবে  কার্গিলে  বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল পাকিস্তান, মন কি বাত-এ সাফ কথা মোদির

যাঁরা ভাবছেন যে ল্যাব্রেডর, জার্মান শেফার্ড ইত্যাদির তুলনায় এসব দেশি নেড়ি নেহাতই এলেবেলে, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই, কেরালাতে পেরিয়ার নদীর ওপর মুল্লাপেরিয়ার বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ যখন চলছিল, তখন নির্মাণ কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাহারা দেওয়ার কাজে ছিপ্পিপারাই প্রজাতির কুকুরদের নিয়োগ করা হয়েছিল। দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষেতের ফসল আর তৃণভূমিতে চড়তে যাওয়া ছাগল, ভেড়াদের সুরক্ষার দায়িত্ব পালং করে এসেছে এই ছিপ্পিপারাই, রাজা পালায়ামরাই।

আর যদি পোষ্য প্রতিপালন সূত্রে সামাজিক মর্যাদা অর্জনের প্রশ্ন ওঠে, কুকুরের জাতের ওপর মালিকের দেখনদারির ব্যাপারটা নির্ভর করে, তাহলে সে ব্যাপারেও আদৌ পিছিয়ে নেই দেশি কুকুররা। আগেকার দিনে দক্ষিণ ভারতে মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে এই ছিপ্পিপারাই কুকুর দেওয়ার প্রথা ছিল।

২০১৬-তে কারনালে অবস্থিত ন্যাশনাল ব্যুরো অব অ্যানিম্যাল জেনেটিক রিসোর্সের পাঁচ গবেষক, কে এন রাজা, পি কে সিং, এ কে মিশ্র, আই গাঙ্গুলি এবং পি দেবেন্দ্রন, একটা গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তাঁরা জানান, দেশীয় কুকুরদের শ্রেণি বিভাগ করা হয় উপযোগিতার ভিত্তিতে। সেই হিসেবে তাঁরা উল্লিখিত প্রজাতির কুকুরদের পাশাপাশি ক্যারাভান হাউন্ড, রামপুর হাউন্ড, কান্নি, বুল্লি, প্রভৃতি প্রজাতির কুকুরদের সন্ধান পেয়েছেন যেগুলো সাধারণভাবে গ্রামীণ মানুষ বাড়িতে পোষে। শুধু পাহারা দেওয়ার জন্য নয়, সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসেবেও তাদের কাছে রাখে।

আধুনিক ভারতে দেশি কুকুর যতই অবজ্ঞাত হোক, বিদেশি কুকুরদের নিয়ে আদিখ্যেতার দৌলতে তারা যতই পেছনের সারিতে চলে যাক, ভারতীয় সারমেয় কিন্তু চিরকাল এরকম অবহেলিত, উপেক্ষিত ছিল না।

আরও পড়ুন : ভারত কখনও সংকটকে ভয় পায়নি : ‘মন কি বাত’-এ স্পষ্ট বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর

ডব্লিউ ভি সোমান ১৯৬৩ সালে ভারতীয় কুকুরদের নিয়ে একটি বই লেখেন। নাম দেন ‘ দি ইন্ডিয়ান ডগ ‘। তাতে তিনি দেখান, ভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহা চিত্রেও মানুষে কুকুরে সখ্য সংবাদ ফুটে উঠেছে। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এদেশের রাজা, রানি, অভিজাতরা শিকারের সঙ্গী থেকে শুরু করে সদা সাথী হিসেবেও কুকুর পুষতেন। আসলে কুকুর পোষা তাঁদের কাছে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক ছিল। বেদে উল্লিখিত হয়েছে ইন্দ্রের কুকুর ‘সরমা’-র কথা। মহাভারতে যুধিষ্ঠির কুকুরকে ছেড়ে স্বর্গে প্রবেশ করতে রাজি হননি।

এই সরমা কিংবা যুধিষ্ঠিরের কুকুর নিশ্চয় ল্যাব্রেডর, জার্মান শেফার্ড, হাস্কি কিংবা শিদজু ছিল না।
সত্যি কথা বলতে কী, ভারতীয় কুকুরেরা বিদেশি প্রজাতির কুকুরদের তুলনায় অনেক বেশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন। তাদের জিনগত ত্রুটি অনেক কম। তারা বাঁচেও অনেক বেশি, প্রায় ১৬-১৭ বছর। বুদ্ধিমত্তা আর পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও তাদের জুড়ি মেলা ভার। এর ওপর যদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তবে তারা বিদেশি কুকুর কুলকে কয়েক আলোকবর্ষ পিছনে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

প্রধানমন্ত্রী তাই মনের কথা তুলে ধরে ভুল কিছু করেননি।

আরও পড়ুন : কিসের ইঙ্গিত? ইউটিউবে প্রধানমন্ত্রীর মন কি বাতে বাঁধভাঙ্গা ডিসলাইক